বৈষ্ণব দার্শনিক শ্রীল জীব গোস্বামী

আবির্ভাব  
প্রসিদ্ধ ভক্তিগ্রন্থপ্রণেতা ও বৈষ্ণব-দার্শনিক শ্রীল জীব গোস্বামী শ্রীরূপ ও সনাতন গোস্বামীর ভ্রাতা শ্রীবল্লভ (মহাপ্রভু প্রদত্ত নাম অনুপম) এর পুত্র। ‘সপ্তগোস্বামী’ গ্রন্থমতে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে ১৪৩৩ শকাব্দে (১৫১১ খ্রিষ্টাব্দে) তিনি আবির্ভুত হন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুরের মতে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের মালদা জেলান্তর্গত রামকেলি শ্রীজীব গোস্বামীর আবির্ভাব স্থান। অনুপমের পুত্র শ্রীজীব গৌড়ে রূপ, সনাতন এবং অনুপমের সাথেই থাকতেন। তাঁদের তিনজনের মহৈশ্বর্যপূর্ণ সংসারে শ্রীজীব একমাত্র পুত্র। বালকের দিব্য গৌরবর্ণ অঙ্গকান্তিতে তাঁদের ঐশ্বর্যময় গৃহ আলোকে উদ্ভাসিত হতো।
শ্রীল রূপ-সনাতন গোস্বামীগণের অপ্রকটের পর গৌরমণ্ডল, ক্ষেত্রমণ্ডল ও ব্রজমণ্ডলের শ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের আচার্যপদে অধিষ্ঠিত থেকে শ্রীল জীব গোস্বামীপাদ গৌরসুন্দরের প্রচারিত শুদ্ধভক্তির মহিমা সকলের মাঝে প্রচার করেন।
মহাপ্রভুর দর্শন লাভ
গৌড়ের রাজধানী রামকেলিতে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের শুভাগমন হলে শ্রীজীব গোস্বামীর স্বীয় ইষ্টদেব দর্শনের সৌভাগ্য লাভ হয়। তখন মহাপ্রভু শ্রীজীব গোস্বামীকে তাঁর স্বীয় শ্রীচরণ কমল রজ দ্বারা গৌড়ীয়- বৈষ্ণব-পরম্পরা-ধারার আচার্যরূপে অভিষিক্ত করেন। অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি মহাপ্রভুর অপূর্ব ভুবনমোহন রূপ তাঁর হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। তাঁর গমন, ভোজন, শয়ন, জাগরণে সর্বদাই তাঁর হৃদয়ে মহাপ্রভুর স্মৃতি জাগরিত হতো।
বাল্যকাল
শ্রীরূপ ও অনুপম প্রয়াগে মহাপ্রভুর দর্শন লাভের পর কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে বৃন্দাবনে গমন করেন। বৃন্দাবনে কিছুদিন অবস্থান করার পর গৌড়দেশ হয়ে নীলাচলে যাত্রা করার পরিকল্পনা করলেন। গৌড়দেশে আসার পর অনুপমের গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়। তারপর শ্রীল রূপ গোস্বামী কিছুদিন গৃহে অবস্থান করার পর নীলাচলে গমন করেন।
পিতা অনুপমের অন্তর্ধানে শ্রীজীব গোস্বামী অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠলেন। সংসার তাঁর কাছে অত্যন্ত বিষময় হয়ে উঠল। ভাবতে লাগলেন বিষময় সংসার ত্যাগ করে কবে তিনি একান্তভাবে মহাপ্রভুর সেবা করতে পারবেন! তাঁর বৈরাগ্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগল। একদিন সন্ধ্যায় তিনি মহাপ্রভুর বিরহে ক্রন্দন করতে করতে নিদ্রার আবেশে স্বপ্নে সপার্ষদ মহাপ্রভুকে দর্শন করলেন। তাঁর শৈশব সম্পর্কে ভক্তিরত্নাকরে উল্লিখিত আছে-
শ্রীজীব বালক-কালে বালকের সনে।
শ্রীকৃষ্ণ-সম্বন্ধ বিনা খেলা নাহি জানে ॥
কৃষ্ণবলরাম মূর্তি নির্মাণ করে।
করতেন পূজা পুষ্পচন্দনাদি দিয়ে ॥
তিনি কৃষ্ণ-বলরামের বিভিন্ন লীলা অনুসরণে খেলা করতেন। কৃষ্ণ-বলরাম একদিন স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে শ্রীজীব গোস্বামীকে দর্শন দান করলেন। তারপর আবার তিনি তাঁদেরকে গৌর-নিত্যানন্দ রূপে দর্শন করলেন। দর্শনের পর প্রণাম করতে গেলে গৌর-নিত্যানন্দ অদৃশ্য হলেন। গৌর-নিত্যানন্দকে দর্শন করতে না পেরে জীব গোস্বামী অস্থির হয়ে পড়লেন।
 নিত্যানন্দ প্রভুর সাথে নবদ্বীপ-ধাম দর্শন
 রাত্রিশেষে নিদ্রা ভঙ্গ হলে তিনি গৃহত্যাগ করে মায়াপুর-নবদ্বীপে যাত্রা করেন। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। এদিকে নিত্যানন্দ প্রভু খড়দহ থেকে এসে শ্রীবাস অঙ্গনে ভক্তগণসহ প্রেমানন্দে অবস্থান করছিলেন। নিত্যানন্দ প্রভু হেসে শ্রীবাস পণ্ডিতকে বললেন- “আমার মনে হয় আজ শ্রীরূপ-সনাতনের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব আগমন করবে। তখনই শ্রীজীবের আগমন সংবাদ এক বৈষ্ণব শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে জানালেন। শ্রীজীব গোস্বামী তখন শ্রীবাসের গৃহের দ্বারে অবস্থান করছিলেন।
শুনি নিত্যানন্দ প্রভু আনন্দিত হৈলা।

শ্রীজীবেরে শীঘ্র লোক দ্বারে আনাইলা ॥

শ্রীজীব অধৈর্য হৈলা প্রভুর দর্শনে।

নিবারিতে নারে অশ্রুধারা দু’নয়নে ॥

করয়ে যতেক দৈন্য কহনে না যায়।

লোটাইয়া পড়ে প্রভু নিত্যানন্দ পায় ॥


তারপর নিত্যানন্দ প্রভু বাৎসল্যে বিহ্বল হয়ে সান্ত¦না বাক্যে শ্রীজীবকে স্থির করালেন। নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীবাসাদি ভক্তদের দ্বারা অনুগ্রহ করিয়ে কয়েকদিন শ্রীজীবকে তাঁর কাছে রাখলেন।


jiva-goswami
নিত্যানন্দ প্রভুর সাথে নবদ্বীপ-ধাম দর্শন
নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীজীবের কাছে শ্রীনবদ্বীপ ধামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন। তারপর তিনি তাঁকে জগন্নাথ মিশ্রের আলয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে ভক্তগণ মহাপ্রভুর গুণগাথা কীর্তন করছিলেন। শ্রীজীব গোস্বামী দেখলেন বৃদ্ধা শচীমাতা গৌরসুন্দরের চিন্তায় অশ্রুমুদিত অবস্থায় বারান্দায় বসে আছেন। নিত্যানন্দ প্রভু তাঁকে শচীমাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে শচীমাতা তাঁদের ভোজন করালেন। নিত্যানন্দ প্রভুর অশেষ কৃপায় জীব গোস্বামীর নবদ্বীপের নয়টি ধাম পরিক্রমা হলো। পরিক্রমা শেষে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু শ্রীজীবকে বৃন্দাবনে যাওয়ার আদেশ দিলেন।


নিত্যানন্দ প্রভুর কাছে শ্রীজীবের প্রশ্ন

তখন শ্রীজীব গোস্বামী শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে নিজ সংশয় ছেদনের জন্য জিজ্ঞেস করলেন- “প্রভু এই নবদ্বীপ ধামই তো বৃন্দাবন। তবে আবার এত যত্ন করে সেখানে যাওয়ার কী প্রয়োজন?” নিত্যানন্দ প্রভু উত্তরে বললেন, “মহাপ্রভুর প্রকটলীলা যতদিন থাকে তখন বহির্মুখ-জন তা জানতে পারে না। নবদ্বীপ বৃন্দাবন একই তত্ত্ব, কিছুমাত্র ভেদ নেই। বৃন্দাবন ধাম রসের আধার এবং রাধাকৃষ্ণ লীলা সর্বরসসার হলেও তাতে সবার অধিকার লাভ হয় না। কিন্তু বৃন্দাবন-অভিন্ন এই নবদ্বীপধামে জীবের সে অধিকার লাভ হয়। তাই ব্রজে গিয়েও সকলে সে রস পায় না বরং অপরাধের কারণে রস বিরসে পরিণত হয়।

নিজের চেষ্টায় ব্রজের রস লাভ করা যায় না। শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের কৃপা হলেই কেবল ব্রজের রস উদিত হবে। রাধাকৃষ্ণই এক স্বরূপে শ্রীনবদ্বীপধামে শ্রীগৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি এ রসের অধিকার জীবকে প্রদান করেন। নবদ্বীপধামে অপরাধ স্থান পায় না। এখানে নামাশ্রয় করলে অপরাধ ক্ষয় হয় এবং যুগল-রসের পীঠ বৃন্দাবন প্রাপ্তির অধিকার লাভ হয়।

এ গোপনীয় তত্ত্ব যাকে-তাকে যেখানে-সেখানে প্রদান করবে না। ব্রজরস লাভ করার জন্য নবদ্বীপ আশ্রয় করা কর্তব্য। তুমি ব্রজরসের অধিকারী, অতএব ব্রজে যাও।”

তারপর শ্রীজীব গোস্বামী আরেকটি প্রশ্ন করলেন, “এ নবদ্বীপে বহু লোক বাস করে কিন্তু তারা কেন কৃষ্ণভক্তি পায় না? ধামে বাস করার পরও কেন অপরাধ হয়?”

নিত্যানন্দ প্রভু উত্তরে বললেন, “এ ধাম চিন্ময়, ধামে কখনও জড়বস্তু প্রবেশ করতে পারে না। ধামের উপর জড়মায়া জাল পেতে চিরকাল আবদ্ধ করে রাখে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সাথে যাদের সম্পর্ক নেই তারা চিরকাল এই জালের উপরেই থাকবে।


মনে ভাবে আমি আছি নবদ্বীপ পুরে।

প্রোঢ়মায়া মুগ্ধ করি রাখে তারে দূরে ॥

যদি কোনো ভাগ্যোদয়ে সাধুসঙ্গ পায়।

তবে কৃষ্ণচৈতন্য সম্বন্ধ আসে তায় ॥


এভাবে জীব গোস্বামীর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি বললেন, “শ্রীল রূপ-সনাতন তোমাকে এ তত্ত্ব আরও গভীরভাবে ব্যক্ত করবেন। মহাপ্রভু তোমাকে ব্রজে বাস করবার অধিকার দিয়েছেন। তুমি শীঘ্র ব্রজে গমন কর।”


বৃন্দাবন যাত্রা

তারপর শ্রীল জীব গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুকে প্রণাম করে বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করলেন। বৃন্দাবনে যাওয়ার পথে তিনি শ্রীল সার্বভৌম ভট্টাচার্যের শিষ্য শ্রী মধুসূদন বাচস্পতির নিকট সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে মহাপ্রভু যে বেদান্ত বর্ণনা করেছিলেন তা শ্রবণ করেন। কাশীতে কিছুদিন অধ্যয়নের পর শ্রীজীব গোস্বামী বৃন্দাবনে শ্রীল রূপ গোস্বামী ও শ্রীল সনাতন গোস্বামীর চরণ দর্শন করলেন। শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীজীব গোস্বামীকে নিজের কাছে রেখে ভাগবত অধ্যয়ন করাতে লাগলেন। শ্রীল রূপ গোস্বামী শ্রীজীবকে মন্ত্রদীক্ষা প্রদান করলেন। শাস্ত্র অধ্যয়নের পাশাপাশি শ্রীজীব একান্তভাবে শ্রীকৃষ্ণভজনে নিবিষ্ট হতেন। তারপর তিনি শ্রীশ্রী রাধা-দামোদরের সেবায় নিযুক্ত হলেন। তিনি নিয়মিত শ্রীল রূপ-সনাতন গোস্বামীর সেবা করতেনÑ তাদের স্নানের জল আনতেন, মাথায় তৈলমর্দন করে দিতেন।


বল্লভভট্ট-বিজয়

একদিন গ্রীষ্মকালে শ্রীল রূপ গোস্বামী বৃন্দাবনে নির্জনে গ্রন্থ লেখার সময় ঘর্মাক্ত কলেবর হলে শ্রীজীব গোস্বামী তাঁকে ব্যজন করছিলেন। তখন বল্লভভট্ট সেখানে এসে রূপ গোস্বামীর সাথে মিলিত হলেন এবং তাঁকে বললেন ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ সংশ্ধোন করে দিবেন। এই বলে বল্লভভট্ট যমুনায় স্নান করতে গেলেন। বল্লভ ভট্টের এমন গর্বিত বচন সহন করতে না পেরে জল আনার ছলে তিনিও যমুনায় গেলেন এবং বল্লভ ভট্টকে শ্রীল রূপগোস্বামীর লেখায় কোথায় ভুল আছে তা জিজ্ঞেস করলেন। বল্লভ ভট্ট সে বিষয়ে তাঁর অভিমত জ্ঞান করলে শ্রীজীব গোস্বামী শাস্ত্রবিচার দ্বারা তাঁর প্রতিটি বাক্য খণ্ডন করলেন। বল্লভ ভট্ট তাঁর অদ্ভূত পণ্ডিত্য দেখে আশ্চর্য হলেন এবং সমস্ত কথা রূপ গোস্বামীকে এসে বললেন। শ্রীরূপ গোস্বামী এজন্য শ্রীজীবকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন।

দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত রূপচন্দ্র বিজয়

রূপচন্দ্র নামে এক দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত বহুদেশ ভ্রমণ করে ব্রজে শ্রীল রূপ-সনাতনের কাছে জয়পত্র লাভের জন্য গর্বভরে বিচার করতে আসেন। কৃষ্ণভজনে নিমগ্ন শ্রীল রূপ-সনাতন গোস্বামীদ্বয় বিনাতর্কে পণ্ডিতকে জয়পত্র লিখে দেন। রূপচন্দ্র শ্রীল রূপ-সনাতনের নিন্দা করতে করতে শ্রীজীবের কাছে গেলে শ্রীজীব গোস্বামী তাকে উচিত শিক্ষা দিতে মনস্থ করেন। তারপর তিনি দিগি¦জয়ী পণ্ডিতকে গৌড়ীয় দ্বৈতবাদী-বৈষ্ণবসিদ্ধান্ত প্রমাণের দ্বারা পরাজিত করেন। 
এ ঘটনা শুনে শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদ অন্তরে সন্তুষ্ট হলেও বাহ্যিকভাবে তাঁকে কঠোর বাক্য প্রয়োগের দ্বারা উপেক্ষা করলেন, “তুমি ভজনের জন্য বৃন্দাবনে এসেছে, কিন্তু এখানে এসে তুমি প্রতিষ্ঠার বশ হয়ে গিয়েছ।” রূপ গোস্বামীর ভর্ৎসনা শুনে শ্রীজীব যমুনার তীরে মুখে বস্ত্র আচ্ছাদন করে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। গুরুদেব কর্তৃক বর্জিত হয়ে কাউকে মুখ দেখাবেন না বলে নির্জন বনে প্রবেশ করে অনাহারে দিন কাটাতে লাগলেন।
বনে বসে তিনি ‘সর্বসম্বাদিনী’ গ্রন্থ লিখলেন। তারপর একবার শ্রীল সনাতন গোস্বামী সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীজীবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। জীব সনাতন গোস্বামীর চরণে পড়লে তিনি রূপগোস্বামীকে বললেন, “তোমার তো জীবে দয়া হলো না।” সনাতন গোস্বামীর কথা বুঝতে পেরে রূপ গোস্বামী জীব গোস্বামীকে আবার ফিরিয়ে আনলেন।
শ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের আচার্য

শ্রীল রূপ-সনাতন গোস্বামীগণের অপ্রকটের পর গৌড়মণ্ডল, ক্ষেত্রমণ্ডল ও ব্রজমণ্ডলের শ্রীগৌড়ীয়-বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের আচার্যপদে অধিষ্ঠিত থেকে শ্রীল জীব গোস্বামীপাদ গৌরসুন্দরের প্রচারিত শুদ্ধভক্তির মহিমা সকলের মাঝে প্রচার করেন।

একসময় সম্রাট আকবরের অধীনস্থ গঙ্গাতীরবর্তী ও রাজস্থানবাসী রাজাগণের মধ্যে গঙ্গা ও যমুনার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে এক বিতর্ক ওঠে। এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সম্রাট আকবর শ্রীল জীব গোস্বামীপাদকে আহ্বান করেন। শ্রীজীব গোস্বামী জানান তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে কোথাও রাত্রিযাপন করবেন না। রাজাগণ ঘোড়ার ডাক বসিয়ে একদিনের মধ্যে বৃন্দাবন যাত্রার ব্যবস্থা করেন। তখন শ্রীজীব গোস্বামীপাদ সিদ্ধান্ত দেন, শ্রীগঙ্গা বিষ্ণুর চরণ থেকে এসেছে অর্থাৎ গঙ্গা বিষ্ণুর চরণামৃত এবং বিষ্ণুশক্তি বটে। কিন্তু যমুনাদেবী কৃষ্ণপ্রেয়সী। সুতরাং রস তারতম্যে শ্রীযমুনাদেবী গঙ্গাদেবী হতে শ্রেষ্ঠা। শ্রীল জীব গোস্বীপাদের এ বিচারে সকলেই সন্তুষ্ট হন।

সম্রাট সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীজীব গোস্বামীকে কিছু উপঢৌকন গ্রহণ করার জন্য নিবেদন করলে শ্রীজীব গোস্বামী তা না নিয়ে কেবল বারাণসি হতে গ্রন্থ লেখার জন্য কাগজ চাইলেন। তিনিই প্রথম আগ্রা থেকে তুলট কাগজ এনে গ্রন্থ লেখার কার্য আরম্ভ করেন। রাধাদামোদর মন্দিরে তিনি সুবৃহৎ গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন, যা এখনো বর্তমান। কিন্তু এখানকার হস্তলিখিত পুঁথিসমূহ বৃন্দাবন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে দিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সম্রাট আকবরে পর অন্যান্য হিন্দুবিদ্বেষী সম্রাটদের আগ্রাসন থেকে বৃন্দাবনের বিগ্রহগণের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি মুঘল রাজদরবারে গিয়ে বৃন্দাবনের মন্দিরসমূহ ও রাধাকুণ্ডের ভূ-সম্পত্তির দলিল করে আনেন এবং বিগ্রহসেবার জন্য বহু জমির বন্দোবস্ত করেন।

তিনি গৌড়দেশ থেকে আগত শ্রীনিবাস, নরোত্তম দাস ও দুঃখী কৃষ্ণদাসকে যোগ্য উপাধিতে ভূষিত করেন। শ্রীনিবাসকে আচার্য, নরোত্তম দাসকে ‘ঠাকুর মহাশয়’, এবং দুঃখী কৃষ্ণদাসকে ‘শ্যামানন্দ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তারপর তিনি তাঁর নিজের রচিত এবং গোস্বামীদের অন্যান্য গ্রন্থ প্রচারের তাঁদের গৌড়দেশে প্রেরণ করেন।


গ্রন্থাবলি

শ্রীল জীব গোস্বামীপাদের হস্তাক্ষর
শ্রীভক্তিরত্নাকরে শ্রীল জীব গোস্বামী লিখিত ২৫টি গ্রন্থের নাম উল্লিখিত হয়েছে- ১. হরিনামামৃত ব্যাকরণ, ২. সূত্রমালিকা, ৩. ধাতুসংগ্রহ, ৪. কৃষ্ণার্চনদীপিকা, ৫. গোপালবিরুদাবলী, ৬. রসামৃতশেষ, ৭. শ্রী মাধব মহোৎসব, ৮. শ্রীসঙ্কল্পকল্পবৃক্ষ, ৯. ভাবার্থসূচক দীপিকা, ১০. গোপালতাপনী টীকা, ১১. ব্রহ্মসংহিতার টীকা, ১২. ভক্তিরসামৃতসিন্ধু টীকা, ১৩. উজ্জ্বলনীলমণিটীকা, ১৪. যোগসারস্তবের টীকা, ১৫. অগ্নিপুরাণস্থ শ্রীগায়ত্রীভাষ্য, ১৬. পদ্মপুরাণোক্ত শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন, ১৭. শ্রীরাধিকা কর-পদস্থিত চিহ্ন, ১৮. গোপালচম্পু (পূর্ব ও উত্তর বিভাগ), ১৯. ক্রমসন্দর্ভ, ২০. তত্ত্বসন্দর্ভ, ২১. ভগবৎসন্দর্ভ, ২২. পরমাত্মা সন্দর্ভ, ২৩ কৃষ্ণসন্দর্ভ, ২৪ ভক্তিসন্দর্ভ, ২৫. প্রীতি সন্দর্ভ, ২৬. সবসম্বাদিনী প্রভৃতি।


শ্রীল জীব গোস্বামীপাদের জপমালা
শ্রীল শ্রীজীব গোস্বামী ভাদ্র শুক্লা-দ্বাদশী তিথিতে আবির্ভূত হন এবং পৌষী শুক্লা-তৃতীয়া তিথিতে তিরোধান লীলা করেন। শ্রীল শ্রীজীব গোস্বামীর সেবিত বিগ্রহ ‘শ্রীরাধাদামোদর জিউ’ বৃন্দাবনে শ্রী রাধাদামোদর মন্দিরে সেবিত হচ্ছেন। শ্রীরাধাদামোদর মন্দিরের পাশে শ্রীজীব গোস্বামীর সমাধিস্থান এবং শ্রীরাধাকুণ্ডের তীরে (ললিতা কুণ্ডের নিকটে) ভজন কুটির বিদ্যমান। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন