বৈদিক দৃষ্টিকোনে জন্মান্তরবাদ

vedic-reincarnation
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রথম শিক্ষা হচ্ছে, আত্মার অবিনাশিতা। এর পরবর্তী শিক্ষাই হচ্ছে জন্মান্তরবাদ। দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি\(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২/১৩) অর্থাৎ, দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোনো দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না। এই শ্লোকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সর্বপ্রথম জন্মান্তরবাদের সরল ব্যখ্যা দেন।
তথাকথিত নাস্তিক বিজ্ঞানী সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য সকলেই দেহাতিরিক্ত সত্ত্বার স্বীকার করে। বৈদিক শাস্ত্রে এ সত্ত্বার নাম বলা হচ্ছে ‘আত্মা’। অন্য শাস্ত্রসমূহে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম দেখা যায়, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য একরকম ভাবেই বর্ণিত আছে। আত্মার অস্তিত্ব ও ক্রিয়া সম্পর্কে সকলেই একমত। সে আত্মার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেটি ‘অবিনশ্বর’, মানে দেহ নষ্ট হলেও যা কখনও নষ্ট হয় না। তাহলে দেহ নষ্ট বা মৃত্যু হলে আত্মা কোথায় যায়?
এ জগতে প্রচলিত বেশিরভাগ শাস্ত্রগ্রন্থ ও দর্শন থেকে তার কয়েকটি ঠিকানা পাওয়া যায়।

  • ভূত-প্রেত দেহ প্রাপ্তি।
  • স্বর্গাদি উন্নততর ভোগের স্থান কিংবা দুঃখ কষ্টে পরিপূর্ণ নরক।
  • এ জগতেই জন্মান্তর প্রাপ্তি।
  • পরম ব্রহ্মে আত্মার নির্বাণ।
  • ভগবদ আলয়ে নিবাস।
বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী, জীব যতক্ষণ পর্যন্ত না মোক্ষ বা পরমমুক্তি লাভের অধিকারি হয়, ততক্ষণ সে পূণ্য বা পাপ কর্মের ফলে কিছুকাল স্বর্গ-নরক ভোগ করে এবং পরিশেষে এ জগতে ফিরে এসে কর্মফল অনুযায়ী নতুন একটি দেহ লাভ করে পুনরায় মোক্ষ লাভের প্রয়াস করে। এখানে বলা আবশ্যক যে, মোক্ষ লাভেরও স্তর বিশেষ আছে। পরমব্রহ্মে লীন হওয়া মোক্ষলাভের নিকৃষ্টতম স্তর, আর সর্বোৎকৃষ্ট স্তর হচ্ছে ভগবানের সেবা করার সুযোগ প্রাপ্ত হওয়া। যাই হোক সারকথা হচ্ছে যে, আত্মার অস্তিত্ব ও অবিনাশিতা স্বীকার করলে তাকে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করতে হবে। আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে কেউ নীতিগতভাবে জন্মান্তর অস্বীকার করতে পারে না।
অনেকেই আছেন যারা মনুষ্যদেহের পর একবার মাত্র জন্মান্তর স্বীকার করে, পুনঃপুন জন্মান্তর স্বীকার করেনা। তারা বলে থাকে যে, মৃত্যুর পর আত্মা অনন্তকালের জন্য স্বর্গ অথবা নরক প্রাপ্ত হয়। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এ মতবাদ পুরোপুরি মেনে নিতে পারে না। কারণ, এ পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে কোনো দিনও ভালো কর্ম করেনি বা কোনো দিন ক্ষুদ্র হলেও অসৎকর্ম করেনি। যে ব্যক্তি কিছু পাপ ও কিছু পুণ্য করেছে, তাকে অনন্তকালের জন্য স্বর্গ বা নরকবাস দেওয়া কি ঠিক?
এক্ষেত্রে জীবাত্মা সুবিচার লাভ করবে যদি তার পুণ্য ও পাপ কর্মের অনুপাতে স্বর্গ ও নরকভোগের দণ্ড দেওয়া হয়। তবুও সেই প্রশ্নটা থেকেই যায় যে, পরিমিত সময় স্বর্গ ও নরকভোগ করার পর আত্মা কোথায় যায়?
বৈদিক শাস্ত্র এর উত্তরে বলছে, পূণ্য ও পাপ কর্মের ফল ভোগান্তে আত্মা মৃত্যুর পূর্বের সময় অর্থাৎ অন্তিমকালের চেতনা অনুযায়ী নতুন জীবদেহ (মানুষ বা অন্য জীব) ধারন করে কারণ গুণসঙ্গোহস্য সদসদযোনি জন্মসু। এভাবে ক্রমাš^য়ে জীব পুনরায় আত্মোপলব্ধি লাভের সুযোগ লাভ করে। যদি একবারেই তাকে অনন্তকালের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, সেটাও নিষ্ঠুরতার নামান্তর। জগতে আমরা দেখতে পাই যে, জন্মদাতা পিতাও কুপুত্রের সঙ্গদোষ ও অপরাধ মার্জনা করে এবং পুনরায় সংশোধনের সুযোগ দেয়। আর, ভগবান তো জগৎপিতা। তিনি অসীম ক্ষমতাবান, অসীম দয়ালু, এ জগতে তার চেয়ে মহান আর কেউ নেই, এ জগতের সকল জীবের প্রতি তিনি সমদর্শী। তিনি নিশ্চয়ই সংশোধনের সুযোগ দিবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে শাস্তির মানেই হচ্ছে পুনর্গঠনের সুযোগ। যদি সংশোধনের সুযোগই না দেওয়া হয়, তবে শাস্তির তো কোনো অর্থই হয় না।
জন্মান্তরবাদের সবচেয়ে বড় চাক্ষুস প্রমাণ হচ্ছে, এ জগতে জীবের ভাগ্য বিড়ম্বনা। কেউ আজন্ম দুঃখী, আর কেউ দুঃখ কি বস্তু তা জানেই না। কেউ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে স্থান পাচ্ছে দুগ্ধফেননিভ কোমল শয্যায়, আর কেউ জন্মের পরক্ষণেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বিধাতার এ ধরনের পক্ষপাতিত্ব কেন? এখানেও কেউ আবার সৃষ্টিকর্তার কঠিন ও সহজ পরীক্ষার দৃষ্টান্তের কথা তুলতে পারেন। কিন্তু এ দৃষ্টান্ত নিতান্ত অমুলক। কেননা পরীক্ষা সহজ ও কঠিনের মাত্রা যদি সমপর্যায়ের না হয়, তবে সৃষ্টিকর্তার বিচারেও পক্ষপাতিত্বে প্রশ্ন উঠে যেতে পারে?
অন্যভাবে যদি বিবেচনা করা হয়, জাগতিক বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় একটি খুন করে, তার শাস্তি একবারে মৃত্যুদণ্ড। আবার কেউ যদি পঞ্চাশটি খুন করে, তার শাস্তিও একবার মৃত্যুদণ্ড। একবার মৃত্যুদণ্ড হলে তাকে তো আরেকবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় ব্যাক্তির শাস্তিতো অনেক কম হয়ে গেল। এদিকে প্রথমোক্ত ব্যক্তি আবার দ্বিতীয় ব্যক্তির শাস্তি সাপেক্ষে তার শাস্তি কমানোর আপীল করতে পারে। সুতরাং একমাত্র বৈদিকশাস্ত্র বিহিত জন্মান্তরবাদ ব্যতীত, অন্যকোনো পন্থায় দুজনের ন্যায়বিচার করা সম্ভব নয়। বৈদিকশাস্ত্রে এ রকম ন্যায়বিচারের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
-
রবিন কুমার সাহা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন