শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুনের ১৬টি প্রশ্ন |
প্রশ্ন
১) স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কী? তিনি কিভাবে কথা বলেন? কীভাবে অবস্থান করেন? এবং কীভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন? (২/৫৪)
উত্তর:
জীব যখন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভূত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। ত্রিতাপ
দুঃখ উপস্থিত হলেও যাঁর মন উদ্বিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যাঁর স্পৃহা হয় না এবং যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনিই স্থিতধী অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ। জড়জগতে
যিনি সমস্ত জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, যিনি প্রিয় বস্তু লাভে আনন্দিত হন না এবং অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে দ্বেষ করেন না, তিনি পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
কূর্ম
যেমন তার অঙ্গসমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলোকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত। দেহবিশিষ্ট
জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু
উচ্চতর স্বাদ আস্বাদন করার ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন। (২/৫৫-৫৯)
প্রশ্ন
২) কর্ম ও বুদ্ধিযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? (৩/১)
উত্তর:
কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না। সকলেই
মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না। যে
ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ, রস আদি ইন্দ্রিয় বিষয়গুলো স্মরণ করে, সেই মূঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু
যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ। তাই
শাস্ত্রোক্ত কর্মসমূহের অনুষ্ঠান করা উচিত, কেননা কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম
না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না। তবে
বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই জড়জগতে বন্ধনের কারণ। (৩/৩-৯)
প্রশ্ন
৩) জীব অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন পাপকর্ম করে? (৩/৩৬)
উত্তর:
রজোগুণ থেকে সমুদ্ভূত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম
সর্বগ্রাসী ও পাপাত্মক; কামই জীবের প্রধান শত্রু। পরমাত্মা
আমাদের দেহের মধ্যে অবস্থান করেন কিন্তু আমাদের পাপকর্ম করতে অনুপ্রাণিত করেন না। কিন্তু
তা সত্ত্বেও জীব পাপকর্মে লিপ্ত হয়। এর
কারণ হচ্ছে রজোগুণের প্রভাবে উদ্ভূত কাম। কামের
অতৃপ্তির ফলেই ক্রোধের উৎপত্তি হয়। কেবল
তাই নয়, মোহ, ঈর্ষা প্রভৃতির উৎপত্তিও হয় কামের ফলেই। আর
এভাবে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার এবং ঈর্ষা এই ছয়টি রিপুর প্রভাবেই জীব পাপে প্রবৃত্ত হয়। তাই
শ্রীল প্রভুপাদ এর তাৎপর্যে বলেছেন, “কাম হচ্ছে জীবের প্রধান শত্রু। এ
কামই শুদ্ধ জীবাত্মাকে এই জড়জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। ক্রোধ
হচ্ছে তমোগুণের প্রকাশ; এভাবে প্রকৃতির বিভিন্ন গুণের প্রভাবে কাম, ক্রোধ আদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ হয়। তাই,
রজোগুণের প্রভাবকে তমোগুণে অধঃপতিত না হতে দিয়ে, যদি ধর্মাচরণ করার মাধ্যমে তাকে সত্ত্বগুণে উন্নীত করা যায়, তাহলে আমরা পারমার্থিক অনুশীলনের মাধ্যমে ক্রোধ-আদি ষড়রিপুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।” পরমেশ্বর
ভগবান শ্রীকৃষ্ণও উপদেশ দিয়েছেন, প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নাশকারী পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর। (৩/৪১) তাহলে আর জীবের পাপে প্রবৃত্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। মন
যদি ভগবানের অপ্রাকৃত সেবায় মগ্ন থাকে, তাহলে নিম্নগামী প্রবৃত্তগুলোতে আকৃষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর থাকে না।
প্রশ্ন
৪) সূর্যদেবের পরে জন্মগ্রহণ করেও, কৃষ্ণ কিভাবে তাকে জ্ঞান দান করেন? (৪/৪)
উত্তর:
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন- “হে পরন্তপ অর্জুন! আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি
সেই সমস্ত জন্মের কথা স¥রণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পার না। যদিও
আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমার আদি চিন্ময়রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।” (৪/৫-৬) ভগবান সাধারণ জীবদের মতো এক দেহ থেকে আরেক দেহে দেহান্তরিত হন না। তাঁকে
সাধারণ জীবদের মতো ভিন্ন ভিন্ন দেহ নিয়ে জন্ম নিতে হয় না। তিনি
যখন আবির্ভূত হন তখন তাঁর একই চিন্ময় তথা সচ্চিদানন্দময় দেহ নিয়ে আবির্ভূত হন। সাধারণ
জীবের মতো তিনি তাঁর পূর্বের জন্মসমূহের কথা ভুলে যান না কারণ, তাঁর জন্ম এবং কর্ম দুই-ই দিব্য। আর
তিনি মূলত সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্মের সংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ হন। আর
এভাবেই তিনি নিজের অপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা আবির্ভূত হয়ে লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে সূর্যদেবকে এই ধর্মজ্ঞান প্রদান করেছিলেন।
প্রশ্ন
৫) কর্মত্যাগ ও কর্মযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেয়? (৫/১)
উত্তর:
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার প্রাথমিক জ্ঞান এবং জড়জগতে তার বন্ধন ও বন্ধনমুক্তির উপায়স্বরূপ ভক্তিযোগের কথা ব্যাখ্যা করেন। তৃতীয়
অধ্যায়ে বলেছেন, যিনি শুধু জ্ঞানের স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তার আর কোনো কর্ম নেই। আবার
চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন পূর্ণজ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে মোহমুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে। এভাবে
একই সঙ্গে ভক্তিভাবমূলক কর্মে নিয়োজিত হতে এবং জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্মত্যাগ করতে পরামর্শ দেওয়ায় অর্জুন বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। অর্জুন
বুঝতে পেরেছিলেন, জ্ঞানের প্রভাবে কর্ম ত্যাগের অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিভোগমূলক কর্মকে ত্যাগ করা। কিন্তু
কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে ভক্তিযোগ সাধন করার জন্য যদি কর্ম করা হয়, তাহলে কর্ম ত্যাগ করা হলো কী করে? তাই তিনি প্রশ্ন করেছেন যে, কর্মত্যাগ ও কর্মযোগের মধ্যে কোনটি শ্রেয়?
তখন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করেন, কর্মত্যাগ, কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। কিন্তু
দুটির মধ্যে কর্মযোগ, কর্মসন্ন্যাস বা কর্মত্যাগ থেকে শ্রেয়। (৫/২) এই কর্মযোগটি কী? মানুষের বোঝা উচিত বাস্তবিকভাবে কোনো কিছুই তার নিজের নয়। সবকিছুই
হচ্ছে ভগবানের সম্পত্তি। আর
যেহেতু সবকিছুই শ্রীকৃষ্ণের, তাই সবই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করতে হয়। আর
সকল কিছু আসক্তিরহিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় সংযুক্ত করা হলে, সেটিই হচ্ছে কর্মযোগ। পরমেশ্বর
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে কর্ম সম্পাদন না করা হলে মূলত আসক্তিরহিত হয়ে বেশিক্ষণ কর্ম করা বা কর্মসন্ন্যাস পালন সম্ভব নয়। তাই
শ্রীল প্রভুপাদ বিশ্লেষণ করেছেন, “কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত না হয়ে, কেবল সকাম কর্ম ত্যাগ করলেই বদ্ধজীবের হৃদয় কলুষমুক্ত হয় না। যতক্ষণ
পর্যন্ত হৃদয় সম্পূর্ণরূপে কলুষমুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ সকাম কর্মের স্তরে কর্ম করতে হয়। কিন্তু
কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম সাধিত হলে তা আপনা থেকেই কর্মফলের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করতে সাহায্য করে এবং তাকে আর জড়জগতে ফিরে আসতে হয় না।” (তাৎ.
৫/২)
প্রশ্ন
৬) যোগের দ্বারা চঞ্চল মনকে স্থির করা যাচ্ছে না কেন? (৬/৩৩)
উত্তর:
মন চঞ্চল ও দুর্দমনীয়। তবে
ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভূত করা যায়। (৬/৩৫) প্রকৃতপক্ষে অষ্টাঙ্গযোগ সাধন কলিযুগের মানুষের জন্য নয়। পাঁচ
হাজার পূর্বে অর্জুনের এই যোগসাধনে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে এতে অপারঙ্গম বলেছেন। তাহলে
বর্তমান প্রেক্ষিতে অন্যের কি কী কথা! শ্রীল প্রভুপাদ ভগবদ্গীতায় অর্জুনের প্রশ্নের সাপেক্ষে বিশ্লেষণ করেছেন, “মনকে দমন করার সবচেয়ে সহজ পন্থা প্রদর্শন করে গেছেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সেই
পন্থা হচ্ছে পূর্ণ দৈন্য সহকারে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করা।” (তাৎ.
৬/৩৪) এবং বৈরাগ্যের প্রকৃতস্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন, “কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল কার্যকলাপ থেকে মনকে অনাসক্ত করার ফলে সহজেই বৈরাগ্য শিক্ষা লাভ করা যায়। বৈরাগ্য
মানে হচ্ছে বিষয়ের প্রতি অনাসক্তি এবং ভগবানের প্রতি আসক্তি।” (তাৎ.
৬/৩৫) আর এভাবে বৈরাগ্য সাধনের দ্বারাই চঞ্চল মনকে স্থির করা সম্ভব, অষ্টাঙ্গযোগের দ্বারা নয়।
প্রশ্ন
৭) পতিত যোগীর গতি কী? (৬/৩৮)
উত্তর:
অর্জুন প্রশ্ন করেছেন যে, যদি কেউ পারমার্থিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েও (চিত্তচাঞ্চল্যের কারণে) পতিত হয়, তবে সেই পতিত যোগীর কী গতি হবে? এ বিষয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চিত করে দিয়েছেন, শুভানুষ্ঠানকারী পরমার্থবিদদের ইহলোকে ও পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না। (৬/৪০) বরং ঐ সমস্ত যোগভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ সদাচারী ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা ধনীদের গৃহে জন্মগ্রহণ করে (৬/৪১) অথবা জ্ঞানবান যোগীগণের বংশে জন্মগ্রহণ করে। (৬/৪২) এভাবে তাঁদের পূর্বসাধিত যোগের মাত্রা অনুসারে তাঁরা বিভিন্ন উন্নত জন্মপ্রাপ্ত হন এবং পূর্বজন্মের পারমার্থিক চেতনার প্রভাবে তিনি পুনরায় তাঁর সাধনা চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত হন। (৬/৪৩) এভাবে তারা পতিত হলেও পরবর্তীতে পূর্বজন্মে কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রভাবে উপযুক্ত জন্ম লাভ করেন এবং তার সাধনা চালিয়ে যেতে পারেন। মূলত,
কৃষ্ণভাবনামৃতের স্বল্প অনুষ্ঠান কখনও বিফলে যায় না।
প্রশ্ন
৮) ব্রহ্ম কি? অধ্যাত্ম কী? কর্ম কী? অধিভূত ও অধিদৈব কাকে বলে? এ দেহে অধিযজ্ঞ কে এবং তিনি এ দেহে কীরূপে অবস্থান করেন? মৃত্যুকালে
জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কীভাবে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন? (৮/১-২)
উত্তর:
নিত্য বিনাশরহিত জীবকে বলা হয় ব্রহ্ম। আর
তার নিত্যস্বভাব হচ্ছে অধ্যাত্ম। জীবের
জড়দেহের উৎপত্তিই (ভূতোদ্ভবকরো বিসর্গঃ) হচ্ছে কর্ম। প্রকৃতপক্ষে
ব্রহ্ম বা জীবের নিত্যস্বভাব বা অধ্যাত্ম হচ্ছে নিরন্তর ভগবানের সেবা করা। কিন্তু
যখন সে এই কর্ম থেকে বিচ্যূত হয়, তখন তাকে জড়জগতে নানাবিধ দেহ ধারণ করতে হয়। তখন
জড়জগতে সে যা কিছু করে তাকে কর্ম বলে অভিহিত করা হয়। জীব
যে জড়াপ্রকৃতিতে পতিত হয় তা হচ্ছে অধিভূত। অধিভূত
হচ্ছে নশ্বর জড়াপ্রকৃতি।
সূর্য-চন্দ্র প্রভৃতি নিয়ে ভগবানের যে বিরাট পুরুষরূপ, তা-ই হচ্ছে অধিদৈব। শ্রীকৃষ্ণের
আংশিক প্রকাশরূপ যে পরমাত্মা, যিনি অন্তর্যামীরূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করছেন, তিনি হচ্ছেন অধিযজ্ঞ। অর্থাৎ
অধিযজ্ঞ পরমাত্মা জীবের হৃদয়ে অবস্থান করেন। হৃদয়ে
স্থিত অন্তর্যামী পরমাত্মার কারণেই জীব এই জগতে স্বাধীনভাবে কর্ম করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে
প্রতিক্ষণই অধিযজ্ঞ পরমাত্মা তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিশেষে
মৃত্যুর সময়ে যিনি তাঁকে (শ্রীকৃষ্ণকে) স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর ভাব প্রাপ্ত হন। মৃত্যুকালে
জীব যে যে ভাব স্মরণ করে, সে তা-ই প্রাপ্ত হয়। এজন্য
অন্তকালে ভগবানকে স্মরণ করতে হলে, অনন্যচিত্তে সর্বক্ষণই তাঁকে স্মরণ করা প্রয়োজন। (৮/৩-৮)
প্রশ্ন
৯) তোমার বিভূতি সকল জানতে ইচ্ছা করি। (১০/১৬-১৭)
উত্তর:
পরমেশ্বর ভগবান বললেন- “হে অর্জুন, আমার দিব্য প্রধান প্রধান বিভূতিসমূহ তোমাকে বলব, কিন্তু আমার বিভূতিসমূহের অন্ত নেই। হে
গুড়াকেশ! আমিই সমস্ত
জীবের হৃদয়ে অবস্থিত পরমাত্মা। আমিই
সর্বভূতের আদি, মধ্য ও অন্ত। আদিত্যদের
মধ্যে আমি বিষ্ণু, জ্যোতিষ্কদের মধ্যে আমি কিরণশালী সূর্য, মরুতদের মধ্যে আমি মরীচি এবং নক্ষত্রদের মধ্যে আমি চন্দ্র। সমস্ত
বেদের মধ্যে আমি সামবেদ, দেবতাদের মধ্যে আমি ইন্দ্র, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমি মন এবং প্রাণীদের মধ্যে আমি চেতনা। রুদ্রদের
মধ্যে আমি শিব, যক্ষ ও রাক্ষসদের মধ্যে আমি কুবের, বসুদের মধ্যে আমি অগ্নি এবং পর্বতসমূহের মধ্যে আমি সুমেরু। হে
পার্থ! পুরোহিতদের মধ্যে আমি প্রধান বৃহস্পতি, সেনাপতিদেব মধ্যে আমি কার্তিক এবং জলাশয়ের মধ্যে আমি সাগর। মহর্ষিদের
মধ্যে আমি ভৃগু, বাক্যসমূহের মধ্যে আমি ওঁকার। যজ্ঞসমূহের
মধ্যে আমি জপযজ্ঞ এবং স্থাবর বস্তুসমূহের মধ্যে আমি হিমালয়। সমস্ত
বৃক্ষের মধ্যে আমি অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমি নারদ। গন্ধর্বদের
মধ্যে আমি চিত্ররথ এবং সিদ্ধদের মধ্যে আমি কপিল মুনি। অশ্বদের
মধ্যে আমাকে সমুদ্র-মন্থনের সময় উদ্ভূত উচ্চৈঃশ্রবা বলে জানবে। শ্রেষ্ঠ
হস্তীদের মধ্যে আমি ঐরাবত এবং মনুষ্যদের মধ্যে আমি সম্রাট। সমস্ত
অস্ত্রের মধ্যে আমি বজ্র, গাভীদের মধ্যে আমি কামধেনু। সন্তান
উৎপাদনের কারণ আমিই কামদেব এবং সর্পদের মধ্যে আমি বাসুকি। সমস্ত
নাগদের মধ্যে আমি অনন্ত এবং জলচরদের মধ্যে আমি করুণ। পিতৃদের
মধ্যে আমি অর্যমা এবং দ-দাতাদের মধ্যে আমি যম। দৈত্যদের
মধ্যে আমি প্রহাদ, বশীকারীদের মধ্যে আমি কাল, পশুদের মধ্যে আমি সিংহ এবং পক্ষীদের মধ্যে আমি গরুড়। পবিত্রকারী
বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি পরশুরাম, মৎস্যদের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা। হে
অর্জুন! সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আমি আদি, অন্ত ও মধ্য। সমস্ত
বিদ্যার মধ্যে আমি অধ্যাত্মবিদ্যা এবং তার্কিকদের বাদ, জল্প ও বিত-ার মধ্যে আমি সিদ্ধান্তবাদ। সমস্ত
অক্ষরের মধ্যে আমি অকার, সমাসসমূহের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব-সমাস, সংহারকারীদের মধ্যে আমি মহাকাল রুদ্র এবং স্রষ্টাদের মধ্যে আমি ব্রহ্মা। সমস্ত
হরণকারীদের মধ্যে আমি সর্বগ্রাসী মৃত্যু, ভাবীকালের বস্তুসমূহের মধ্যে আমি উদ্ভব। নারীদের
মধ্যে আমি কীর্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা। সামবেদের
মধ্যে আমি বৃহৎসাম এবং ছন্দসমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী। মাসসমূহের
মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ এবং ঋতুদের মধ্যে আমি বসন্ত। সমস্ত
বঞ্চনাকারীদের মধ্যে আমি দ্যূতক্রীড়া এবং তেজস্বীদের মধ্যে আমি তেজ। আমি
বিজয়, আমি উদ্যম এবং বলবানদের মধ্যে আমি বল। বৃষ্ণিদের
মধ্যে আমি বাসুদেব এবং পা-বদের মধ্যে আমি অর্জুন। মুনিদের
মধ্যে আমি ব্যাস এবং কবিদের মধ্যে আমি শুক্রাচার্য। দমনকারীদের
মধ্যে আমি দ- এবং জয় অভিলাষীদের মধ্যে আমি নীতি। গুহ্য
ধর্মের মধ্যে আমি মৌন এবং জ্ঞানবানদের মধ্যে আমিই জ্ঞান। হে
অর্জুন! যা সর্বভূতের বীজস্বরূপ তাও আমি, যেহেতু আমাকে ছাড়া স্থাবর ও জঙ্গম কোনো বস্তুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
হে
পরন্তপ! আমার দিব্য বিভূতি-সমূহের অন্ত নেই। আমি
এই সমস্ত বিভূতির বিস্তার সংক্ষেপে বললাম। ঐশ্বর্যযুক্ত,
শ্রীসম্পন্ন ও বলপ্রভাবাদির আধিক্যযুক্ত যত বস্তু আছে, সে সবই আমার তেজাংশসম্ভূত বলে জানবে।” (১০/২০-৪১)
প্রশ্ন
১০) তোমার ঐশ্বরীয় রূপ দেখতে ইচ্ছা করি। (১১/৪)
উত্তর-
পরমেশ্বর ভগবানের এই অপ্রাকৃত বিভূতিসমূহ শ্রবণ করে অর্জুন তাঁর নিকট তাঁর এই বিভূতির প্রকাশরূপ ঐশ্বর্যময় স্বরূপের দর্শন কামনা করেন। পরমেশ্বর
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁকে দিব্যদৃষ্টি প্রদান করে সেই অদ্ভূত স্বরূপ দেখান। সেই
স্বরূপ হচ্ছে নানা বর্ণ ও নানা আকৃতিবিশিষ্ট সহ¯্র সহ¯্র দিব্যরূপ সমন্বিত। সেখানে
দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র প্রভৃতি সমস্ত দেবগণ অবস্থিত। সেখানে
সম্পূর্ণ স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক বিশ্ব বিদ্যমান। সেই
স্বরূপে তিনি এই সমস্ত বিশ্বের অধীশ্বর এবং জড়াপ্রকৃতির মূল উৎস তা প্রকাশ করেন। সেই
স্বরূপ সহ¯্র সূর্যের চেয়েও কোটিগুণে অধিক প্রভান্বিত, তা দিব্য এবং অপ্রাকৃত।
প্রশ্ন
১১) তোমার উগ্ররূপের পরিচয় কী? (১১/৩৩)
উত্তর-
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন (১১/৩২)- “আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল এবং এসমস্ত লোক সংহার করবার জন্য এখন প্রবৃত্ত হয়েছি। তোমরা
পা-বেরা ছাড়া উভয়পক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধাই নিহত হবে।” এভাবে
তিনি প্রতিপন্ন করেছেন যে তিনিই যেমন এই সমস্ত সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, তেমনি তিনিই সকলকিছুর প্রকৃত সংহার কর্তা। অর্জুনের
পক্ষে যুদ্ধ না করার কোনো স্বাভাবিক কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে
সকল কিছুর ধ্বংসই তাঁর অপ্রাকৃত ইচ্ছার দ্বারা নির্ণীত হয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন
১২) অনন্য ভক্তিযোগী ও নির্বিশেষ ব্রহ্ম উপাসকের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ? (১২/১)
উত্তর-
যারা তাদের মনকে ভগবানের সবিশেষ রূপে নিবিষ্ট করেন এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর ভগবানের উপাসনা করেন, তাঁরাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী। আর
যাদের মন ভগবানের অব্যক্ত নির্বিশেষ রূপের প্রতি আসক্ত, তাদের ক্লেশ অধিকতর। (১২/৩-৫)
প্রশ্ন
১৩) প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় কী ? (১৩/১)
উত্তর-
এ দেহটি হচ্ছে ক্ষেত্র। আর
যিনি এ দেহকে জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ। (১৩/২) মূলত শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমগ্র ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ, যেহেতু তিনি সমস্ত দেহ এবং দেহধারী জীব সম্বন্ধে জানেন। (১৩/৩) এই ক্ষেত্র পঞ্চ মহাভূত, অহংকার, মন, বুদ্ধি, অব্যক্ত, দশ ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ের পাঁচটি বিষয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, সংঘাত, চেতনা এবং ধৃতি- এই সমস্ত বিকারযুক্ত। (১৩/৬-৭)
মানশূন্যতা,
দম্ভহীনতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, স˜গুরুর সেবা, শৌচ স্থৈর্য, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয় বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকারশূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি আদি দোষ দর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদিতে আসক্তিশূন্যতা, সুখে-দুঃখে ঔদাসীন্য, সর্বদা সমচিত্ত্বত্ব, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনন্যা এবং অব্যাভিচারিণী ভক্তি, নির্জন স্থান প্রিয়তা, জনাকীর্ণ স্থানে অরুচি, অধ্যাত্ম জ্ঞানে নিত্যত্ববুদ্ধি এবং ততত্বজ্ঞানের প্রয়োজন অনুসন্ধান- এই সমস্তই হচ্ছে জ্ঞান। আর
এর বিপরীতে যা কিছু, তা-ই অজ্ঞান। (১৩/৮-১২) সমস্ত জীবের অধীশ্বর পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন একমাত্র জ্ঞেয়। (১৩/১৩-১৯)
প্রকৃতি
ও পুরুষ উভয়েই অনাদি। প্রকৃতি
হচ্ছে সমস্ত জড়ীয় কার্য ও কারণের হেতু। আর
জড়ীয় সুখ-দুঃখ ভোগের হেতু হচ্ছে পুরুষ বা জীব। জড়া
প্রকৃতিতে অবস্থিত হয়ে পুরুষ (জীব) প্রকৃতিজাত গুণসমূহ ভোগ করে। প্রকৃতির
গুণের সাহচর্যে জীব বিভিন্ন যোনি ভ্রমণ করে। তবে
এ শরীরে আরেকজন পরম পুরুষ রয়েছেন, যিনি হচ্ছেন উপদ্রষ্টা (সাক্ষী), অনুমন্তা (অনুমোদনকারী), ভর্তা (পালক), ভোক্তা (ভোগকারী), মহেশ্বর (পরমেশ্বর) এবং তাকে পরমাত্মাও বলা হয়। (১৩/২১-২৩)
প্রশ্ন
১৪) ত্রিগুণাতীত পুরুষের লক্ষণ ও আচরণ কি ? (১৪/২১)
উত্তর:
যিনি প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ আবির্ভূত হলে দ্বেষ করেন না এবং সেগুলো নিবৃত্ত হলেও আকাক্সক্ষা করেন না; যিনি উদাসীনের মতো অবস্থিত থেকে গুণসমূহের দ্বারা বিচলিত হন না; কিন্তু গুণসমূহ স্বীয় কার্যে প্রবৃত্ত হয়, এভাবেই জেনে অবস্থান করেন এবং তার দ্বারা চঞ্চলতা প্রাপ্ত হন না; যিনি আত্মস্বরূপে অবস্থিত এবং সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন; যিনি মাটির ঢেলা, পাথর ও স্বর্ণে সমদৃষ্টিসম্পন্ন; যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয়ে সমভাবাপন্ন; যিনি ধৈর্যশীল এবং নিন্দা, স্তুতি, মান ও অপমানে সমভাবাপন্ন; যিনি শত্রু ও মিত্র উভয়ের প্রতি সমভাবসম্পন্ন এবং যিনি সমস্ত কর্মোদ্যম পরিত্যাগী- তিনিই গুণাতীত বলে কথিত হন। (১৪/২২-২৫)
প্রশ্ন
১৫) শাস্ত্রবহির্ভূত শ্রদ্ধা কীরূপ ? (১৭/১)
উত্তর:
জীবের স্বভাবানুযায়ী শ্রদ্ধাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়
সাত্ত্বিক:
দেবতাদের পূজা।
রাজসিক:
যক্ষ ও রাক্ষসদের পূজা। ও
তামসিক:
ভূত ও প্রেতাত্মাদের পূজা। (১৭/৪)
প্রশ্ন
১৬) সন্ন্যাস ও ত্যাগ শব্দের পৃথক তাৎপর্য জানতে ইচ্ছা করি। (১৮/১)
উত্তর:
পণ্ডিতগণ কাম্য কর্মসমূহ ত্যাগকে ‘সন্ন্যাস’ বলেন এবং সমস্ত কর্মফল (কাম্য কর্ম ও নিত্য কর্ম) ত্যাগকে ‘ত্যাগ’ বলে থাকেন। কর্মফলের
আকাক্সক্ষাযুক্ত যে কর্ম, তা ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু
পারমার্থিক উন্নতিকল্পে সাধিত কর্ম পরিত্যাগ করা যাবে না। (১৮/২)
* এখানে
প্রথম বন্ধনীর মধ্যে শুধু শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে তথ্যসূত্র প্রদান করা হয়েছে। প্রথম
সংখ্যাটি অধ্যায় ও দ্বিতীয়টি শ্লোকসংখ্যা জ্ঞাপক।