একাদশী পালন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর লীলাবিলাসের প্রথম থেকেই একাদশীর উপবাসের প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। শ্রীল জীব গোস্বামী তাঁর ভক্তিসন্দর্ভ গ্রন্থে স্কন্দ পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “যে মানুষ একাদশীর দিন পঞ্চশস্য আহার করে, সে সেই খাদ্যের সাথে সাথে তার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, আত্মীয়স্বজন, ব্রাহ্মণ এমনকি গুরু হত্যার পাপও ভক্ষণ করে। যদি সে বৈকুণ্ঠলোকেও উন্নীত হয়, তবুও তার অধঃপতন হয়।” একাদশীর দিন বিষ্ণুর জন্য সবকিছু রন্ধন করা হয়, এমনকি অন্ন এবং ডালও, কিন্তু শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, সেদিন বিষ্ণুর প্রসাদ (অন্ন) পর্যন্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। বিধবা না হলেও শাস্ত্র অনুসারে একাদশীর ব্রত পালন করার প্রথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন।
(দ্রষ্টব্য- ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” আদিলীলা, (১৫/৮-১০)
ekadosi-details-to-know-hksamacar
ভক্তিসহকারে একাদশী ব্রত পালন করলে সকল প্রকার যজ্ঞ ও ব্রত পালনের ফল লাভ হয়ে থাকে। এ তিথিতে অন্নগ্রহণকারীকে পশুর থেকেও নিকৃষ্ট বলে শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে। অনেকের ধারণা ‘শ্রীপুরীধামে শ্রীজগন্নাথের অন্নপ্রসাদ ভক্ষণ দোষাবহ নহে’, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে পুরীতে অনেকেই নিঃসঙ্কোচে অন্ন প্রসাদ গ্রহণ করেন, তা সম্পূর্ণ শাস্ত্রবিরুদ্ধ বিচার।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর সধবা জননী শ্রীশচীদেবীকে এ ব্রত পালন করতে অনুরোধ করেছিলেন। একাদশী তিথিতে নিরম্বু উপবাস করাই শ্রেয়। কিন্তু যারা উপবাস করতে একেবারেই অসমর্থ তারা একাদশীর প্রসাদরূপে অল্প পরিমাণে ফলমূল, সব্জি (সীম ও মটরশুটি বাদে), দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। সারাদিন হরিভক্তসঙ্গে শ্রীভগবানের নাম-রূপ-গুণ-লীলাদি শ্রবণ কীর্তন স্মরণাদি করতে হয় এবং রাত্রে জাগরণ ও হরিকথা শ্রবণ করা প্রয়োজন। একাদশী ব্রত পালনের সময়ে পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, দুরাচারী দর্শন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
একাদশী তিথিতে পঞ্চশস্য ধান, গম, যব, ভূট্টা ও সরিষা (তেলবীজ) জাতীয় যাবতীয় খাদ্য বর্জনীয়। এ তিথিতে সমস্ত পাপ এসকল শস্যের ভেতর অবস্থান করে। রন্ধনকার্যে সরিষা ব্যতীত অন্য সকল মশলা ব্যবহার করা যায়। গুঁড়ো হিং ব্যবহার করা যাবে না। ষটতিলা একাদশী ব্যতীত অন্য একাদশীতে তিলশস্যও বর্জনীয়। শস্যদানার সাথে পূর্বে মেশানো হয়েছে এমন দ্রব্যও বর্জনীয়। যেমন ঘি, যা কিনা পূর্বে পুরী ভাজতে ব্যবহার করা হয়েছে, অথবা চাপাটির ময়দার সঙ্গে হাতের দ্বারা স্পর্শ করা মশলার ব্যবহার করা যাবে না। পঞ্জিকাতে পারণের যে সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের ভেতর শস্যজাতীয় প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত আবশ্যক।
একাদশীতে উপবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেবল অনাহারে উপবাস করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে গোবিন্দ বা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অধিক শ্রদ্ধা ও প্রেমপরায়ণ হওয়া। ‘উপ’ মানে নিকটে, ‘বাস’ মানে অবস্থান করা অর্থাৎ শ্রীহরির নিকটে অবস্থান করা। একাদশীর দিন উপবাস করার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, শারীরিক আবশ্যকতাগুলো খর্ব করে ভগবানের মহিমা কীর্তন এবং ভগবানের সেবা করে সময়ের সদ্ব্যবহার করা।

বিদ্ধা একাদশী
অনেক সময় অন্যান্য পঞ্জিকাগুলোতে ‘গোস্বামীমতে পরাহে’ কথাটি লেখা থাকে। বৈষ্ণবগণ সেক্ষেত্রে পরদিন একাদশী ব্রত পালন করে থাকেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে, পরদিন নামেমাত্র একাদশী তিথি থাকে কিংবা নাও থাকতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে অনেকে সন্দিহান থাকেন। নিন্মোক্ত আলোচনায় তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাসধৃত গরুড় পুরাণ ও শিবরহস্য বচনে বলা হচ্ছে-
উদয়াৎ প্রাক্ যদা বিপ্র মুহূর্তদ্বয় সংযুতা।
সম্পূর্ণৈকাদশী নাম তত্রৈবাপসেদগৃহী ॥
(হ.ভ.বি ১২/১২১)
- “হে দ্বিজ! সূর্যোদয়ের পূর্বে দুই মুহূর্ত (৪৮x২=৯৬ মিনিট) একাদশী থাকলে তাকে সম্পূর্ণা একাদশী বলে। এ দিনেই উপবাস করা বিধেয়।”
ভবিষ্যপুরাণ বচন-
অরুণোদয় বেলায়াং দশমী সংযুতা যদি।
অত্রোপোষ্যা দ্বাদশী স্যাৎ ত্রয়োদশ্যান্তু পারণম্ ॥
(হ.ভ.বি ১২/১২৪)
- “অরুণোদয় সময়ে দশমীবিদ্ধা একাদশী উপস্থিত হলে দ্বাদশীতে উপবাসপূর্বক ত্রয়োদশীতে পারণ করতে হয়।”
একাদশীতে সূর্যোদয়ের পূর্বে বা সূর্যোদয়কালে (১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের মধ্যে) যদি দশমী স্পর্শ হয়, তাকে দশমী বিদ্ধা বলে। দশমী বিদ্ধা একাদশী বাদ দিয়ে দ্বাদশী সংযুক্তা একাদশী ব্রত পালন করতে হয়। এটাই সর্বশাস্ত্রসম্মত বিধি

বিদ্ধা একাদশী পালনের ফল
শ্রীগরুড় পুরাণের পূর্ব্বখণ্ডে একাদশী মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে ১২৫তম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
মান্ধাতা চক্রবর্ত্ত্যাসীদুপোষ্যৈকাদশীং নৃপঃ।
একাদশ্যাং ন ভূঞ্জীত পক্ষয়োরুভয়োরপি ॥১॥
দশম্যেকাদশীমিশ্রা গান্ধার্য্যা সমুপোষিতা।
তস্যাঃ পুত্রশতং নষ্টং তস্মাত্ত্যং পরিবর্জ্জয়েৎ ॥২॥
দশম্যেকাদশী যত্র তত্র সন্নিহিতোহসুরঃ।
দ্বাদশ্যেকাদশী যত্র তত্র সন্নিহিতো হরিঃ ॥৩॥
বহুর্বাক্যবিরোধেন সন্দেহো জায়তে যদা।
দ্বাদশী তু তদা গ্রাহ্যা ত্রয়োদশ্যান্ত পারণম্ ॥৪॥
একাদশী কলাপি স্যাদুপোষ্যা দ্বাদশী তদা ॥৫॥
একাদশী দ্বাদশী চ বিশেষেণ ত্রয়োদশী।
ত্রিমিশ্রা সা তিথিগ্রাহ্যা সর্ব্বপাপহরা শুভা ॥৬॥
একাদশীমুপোষ্যৈব দ্বাদশীমথবা দ্বিজ।
ত্রিমিশ্রাঞ্চৈব কুর্ব্বীত ন দশম্যা যুতাং কচিৎ ॥৭॥
রাত্রৌ জাগরণং কুর্ব্বন্ পুরাণশ্রবণং নৃপঃ।
গদাধরং পূজয়াশ্চ উপোষ্যৈকাদশীদ্বয়ম্।
রুক্মাঙ্গদো যযৌ মোক্ষমন্যে চৈকাদশীব্রতম্ ॥৮॥
অনুবাদ: ব্রহ্মা বললেন, - প্রাচীনকালে মান্ধাতা নামে এক রাজা ছিলেন; তিনি একাদশীতে উপবাস করার ফলস্বরূপ সসাগরা ধরার একমাত্র অধীশ্বর হয়েছিলেন; অতএব শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশীতে কেউ ভোজন করবে না। গান্ধারী দশমীসংযুক্তা একাদশীতে উপবাস করেছিলেন, এজন্য গান্ধারীর শত পুত্র বিনষ্ট হয়; অতএব দশমীযুক্তা একাদশী বর্জন করবে। তাতে কেউ উপবাস করবে না। দশমীযুক্তা একাদশীতে অসুর সন্নিহিত থাকে, দ্বাদশীযুক্ত একাদশীতে হরি সন্নিহিত থাকেন, তবে নানাবিধ শাস্ত্রের বাক্য-বিরোধ দৃষ্টে সন্দেহ উপস্থিত হলে, অর্থাৎ একদিনেই যদি দশমী একাদশী ও দ্বাদশীর যোগ হয়, তবে তখন দ্বাদশীতে উপবাস করে ত্রয়োদশীতে পারণ করবে। যদি দ্বাদশী দিনে এক কলা মাত্র একাদশীও থাকে, তবুও দ্বাদশী দিনেই উপবাস করা কর্তব্য। যেদিন একাদশী, দ্বাদশী ও ত্রয়োদশী এই তিথিত্রয়ের মিশ্রণ হয়, সে দিনে উপবাস করলে সর্বপ্রকার পাপ নাশ হয়। যেদিন শুদ্ধ একাদশী থাকে সে দিনেই উপবাস করা কর্তব্য, কিংবা দ্বাদশীযুক্ত একাদশীতেও উপবাস করতে পারে; অথবা যদি একদিন একাদশী, দ্বাদশী ও ত্রয়োদশী এই তিথিত্রয়ের মিলন হয়, তবে উপবাস করবে, উপরন্তু কখনও দশমীযুক্তা একাদশীতে উপবাস করবে না। রাত্রি জাগরণ, পুরাণশ্রবণ ও গদাধরের অর্চনা করে একাদশীর উপবাস করবে; রুক্মাঙ্গদ রাজা এরূপ একাদশীতে উপবাস করে মোক্ষপদ পেয়েছিলেন।

মহাদ্বাদশী প্রসঙ্গ
একাদশী ব্রত প্রসঙ্গে মহাদ্বাদশী সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। মহাদ্বাদশীর আগমন ঘটলেও শাস্ত্রমতে পরদিন ব্রত পালন করা বিধিসম্মত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আটটি মহাদ্বাদশীর উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে উন্মীলনী, ব্যঞ্জুলী, ত্রিস্পৃশা, পক্ষবর্ধিনী - এ চারটি তিথি ঘটিত এবং জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী ও পাপনাশিনী - এ চারটি নক্ষত্রঘটিত। সম্পূর্ণা একাদশী যদি বৃদ্ধি পেয়ে পরদিন সকালকে স্পর্শ করে তবে তাকে উন্মীলনী মহাদ্বাদশী বলে। সূর্যোদয় থেকে আরম্ভ করে একাদশী সম্পূর্ণা হলে এবং দ্বাদশীও পূর্ণ হয়ে তার পরের দিন ত্রয়োদশীতে কিছু অংশ থাকলে এ দ্বাদশীকে ‘ব্যঞ্জুলী’ বলা হয়। দিবাভাগের প্রথমে একাদশী তারপর সমস্ত দিন দ্বাদশী এবং শেষরাত্রিতে ত্রয়োদশী যুক্ত হলে তা ‘ত্রিস্পৃশা’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। অমাবস্যা বা পূর্ণিমা সম্পূর্ণ হয়ে প্রতিপদে কিছুমাত্র থাকলে তার পূর্বের দ্বাদশী তিথির নাম ‘পক্ষবর্ধিনী’ মহাদ্বাদশী। শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে ‘পুনর্বসু’ নক্ষত্র যোগে ‘জয়া’, ‘শ্রবণা নক্ষত্র যোগে ‘বিজয়া, ‘রোহিণী’ নক্ষত্র যোগে ‘জয়ন্তী’ এবং ‘পুষ্যা’ নক্ষত্র যোগে ‘পাপনাশিনী’ মহাদ্বাদশী সংঘটিত হয়। এছাড়া হরিভক্তিবিলাসে শ্রাবণ ও গোবিন্দ দ্বাদশী নামে আরো দুটি দ্বাদশী ব্রতের উল্লেখ রয়েছে। --মহাদ্বাদশী সম্পর্কে আরোও জানুন
mahadvadosi
মহাদ্বাদশী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন