শ্রীল গৌরীদাস পণ্ডিতের প্রতি কৃপাপূর্বক শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের শ্রীবিগ্রহ প্রকাশ

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন, “শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর দ্বাদশ গোপালের অন্যতম হচ্ছেন গৌরীদাস পণ্ডিত।” শ্রীগৌরগণোদ্দেশ-দীপিকা অনুসারে তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তম সুবল সখা। তিনি গৌরলীলায় নদীয়ার শালিগ্রামে কংসারি মিশ্র ও কমলা দেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি অম্বিকা কালনায় বসবাস শুরু করেন। শ্রীবিগ্রহ যে ভগবানের অভিন্ন-স্বরূপ, তা শ্রীগৌরীদাসের সঙ্গে  নানাবিধ লীলাবিলাসের মাধ্যমে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু প্রকাশ করেছেন।
gauridas_pandit

শ্রীভক্তিরত্নাকরে সপ্তম তরঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, একদিন শ্রীগৌরসুন্দর শান্তিপুর থেকে নৌকা চালিয়ে অম্বিকা কালনায় এসে এক তেঁতুল বৃক্ষতলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেখানে গৌরীদাস পণ্ডিতের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মহাপ্রভুকে গৃহে এনে বহু সেবা করেন। মহাপ্রভু তাকে তখন সেই নৌকার বৈঠা দিয়ে বলতে লাগলেন, 
গঙ্গা পার হৈলু নৌকা বাহিয়া বৈঠায়।
 এই লেহ বৈঠা এবে দিলাম তোমায় ।।
 ভবনদী হৈতে পার করহ জীবেরে ।
 এরপর মহাপ্রভু তাঁকে মায়াপুরে নিয়ে গেলেন এবং তাঁর নিজ হস্তে অনুলিখিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা প্রদান করলেন। এই বৈঠা এবং গীতা এখনও অম্বিকা কালনায় শ্রীগৌরীদাসের বাসভবনে বিদ্যমান।
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যখন তাঁর নবদ্বীপলীলা সমাপন করে যখন সন্ন্যাসলীলা গ্রহণের ইচ্ছা করেন, তখন একদিন তিনি গৌরীদাসের নিকট বিদায় গ্রহণ করতে আসেন। গৌরীদাস পণ্ডিত খুব বিরহ কাতর হলে মহাপ্রভু তাঁকে নিত্যানন্দ প্রভুর সাথে নিজ বিগ্রহ নির্মাণের আদেশ প্রদান করে বলেন, এই বিগ্রহ রূপেই আমরা তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাল্যকালে এক নিমবৃক্ষতলে শচীমাতা একবার ষষ্ঠীদেবীর পূজা করেছিলেন। সেই প্রাচীন বৃক্ষতলে মহাপ্রভু খেলাধুলা করতেন। যদিও বৃক্ষটি ফলহীন ছিল, কিন্তু এর পুষ্পের সুগন্ধ ছিল অত্যাশ্চর্য। এই বৃক্ষে কখনও কোনো পাখি বসতে দেখা যায়নি। মহাপ্রভুর আজ্ঞায় গৌরীদাস নবদ্বীপ হতে সেই বৃক্ষ নিয়ে এসে গৌরনিতাই শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করলেন। তিনি শ্রীবিগ্রহের সেবা করতে করতে গৌর-নিত্যানন্দের প্রেমে ডুবে রইলেন।
একদিন সেই বিগ্রহদ্বয় গৌরীদাসকে বলতে লাগলেন, “গৌরীদাস! তুমি পূর্বে সুবল সখা ছিলে। তোমার কি তা মনে নেই, যমুনা পুলিনে আমরা কত খেলা করেছি?”
তখন শ্রীগৌর-নিতাই শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম স্বরূপ প্রকাশ করলেন এবং গৌরীদাস পণ্ডিত সুবল স্বরূপ প্রকাশিত হলো। এভাবে কিছুক্ষণ লীলাবিলাস করে শ্রীনিতাই-গৌরাঙ্গ আবার সিংহাসনে আসীন হলেন। 
শ্রীগৌরীদাস প্রতিদিন নানাবিধ ব্যঞ্জন রন্ধন করে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দের ভোগ দিতেন, তাঁরা তাঁর নিবেদিত ভোগ স্বহস্তে গ্রহণ করতেন। অতিশয় বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হলেও তার সেবা বন্ধ করলেন না। সমস্ত শারীরিক ক্লেশ সহন করে তিনি চিন্ময় সেবায় নিয়োজিত রইলেন। তাঁর কষ্ট সইতে না পেরে গৌর-নিত্যানন্দ একদিন বাহ্যিক প্রণয় রোষ করে ভোগ গ্রহণ না করে অভুক্ত রইলেন। 
তখন গৌরীদাস বরলেন, “যদি ভোগ গ্রহণ না করেই তোমরা আনন্দিত থাকো, তাহলে আমাকে দিয়ে রান্না করাও কেন?” 
এই বলে তিনিও প্রণয়রোষ প্রকাশ করে মৌন হয়ে বসে রইলেন। 
তখন গৌর-নিত্যানন্দ বলতে লাগলেন, “তোমার রান্না তো আর অল্প ব্যাপার নয়। তোমার এত বিভিন্ন প্রকার রান্নার শ্রমও সহন করতে পারি না, আবার তুমি নিষেধও মানো না। তাই ভাবলাম না খেয়েই রইব।” 
গৌরীদাস বললেন, “তাহলে আর নানাবিধ ব্যঞ্জন রান্না করব না। শুধু একটি শাকই রান্না করে খেতে দিব।” 
তখন গৌর-নিত্যানন্দ হাসতে হাসতে ভোজন করতে লাগলেন।
এভাবে প্রত্যহ নানাবিধ লীলাবিলাস করে শ্রীগৌর-নিত্যানন্দ শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিতের গৃহে বিরাজমান রইলেন।  
~মাধুর্য  দাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন