নিজেদের কামনা-বাসনাপূর্তির কোনো প্রার্থনা নয়, দুর্গাদেবীর নিকট আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত তিনি যেন আমাদেরকে এ জড়জগতে পতিত হয়ে বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তনরূপ দুর্গতি সম্পূর্ণরূপে নাশ করেন।
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্য মহাসুরম্।
দুর্গাদেবীতিবিখ্যাতাং তন্মে নাম ভবিষ্যতি ॥
দুর্গাদেবীতিবিখ্যাতাং তন্মে নাম ভবিষ্যতি ॥
অনুবাদ: দুর্গম নামে এক ভয়ানক মহা অসুরকে বধ করার জন্য আদ্যাশক্তি এ জগতে দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা। (মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৯২/৪৫)
এছাড়া ব্যুৎপত্তিগত অর্থ-বিশ্লেষণে জানা যায়, (র্দু + √গৈ/গম্ + অ + আ) -যাকে অনেক কষ্টে উপলব্ধি করা যায় তিনি ‘দুর্গা’। আবার, তিনি এই জড়জগৎরূপ দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাই তিনি ‘দুর্গা’ নামে অভিহিতা। বাংলা ভাষাভাষী আমরা সাধারণত আদ্যাশক্তি মহামায়ার দশভুজা ‘মহিষমর্দিনী’ রূপ দর্শনে অভ্যস্ত। তাই এ রূপটিকেই দুর্গা বলে থাকি। কিন্তু পুরাণান্তরে দুর্গাদেবীর চতুর্ভুজা, অষ্টভুজা, অষ্টাদশভুজা প্রভৃতি বিভিন্ন রূপ রয়েছে। বাংলা ব্যতীত ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে দুর্গা পূজার চেয়ে ‘নবরাত্রি’ অনেক বেশি প্রসিদ্ধ। সেখানে মহালয়ার পরদিন থেকে মহানবমী পর্যন্ত নয়টি রূপে দেবী দুর্গা পূজিতা হয়ে থাকেন। আশ্বিন মাসে শারদীয়া দুর্গাপূজার যে প্রচলন তার সূত্রপাত রাজা কংসনারায়ণের মাধ্যমে। তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাদেবীর অকাল-বোধনের কথাই বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত। এধরনের কোনো কথা মহর্ষি বাল্মিকী রচিত মূল রামায়ণ কিংবা তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস প্রভৃতি অন্যান্য রামায়ণসমূহে দৃষ্ট হয় না। তাই নিঃসন্দেহে বলা চলে এটি পরবর্তী সংযোজন। তবে পুরাণান্তরে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে দেবীপূজার কথা আমরা দেখতে পাই। মার্কণ্ডেয় পুরাণে রাজ্যহারা নরাধিপ সুরথ ও পুত্রদ্বারা বর্জিত এক বৈশ্যশ্রেষ্ঠ সমাধি কর্তৃক দুর্গা দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা স্থাপন করে আরাধনার কথা উল্লেখ আছে। মেধা নামক প্রথিতযশা ঋষিবরের প্রদত্ত বিধানানুযায়ী তারা একাধারে তিন বছর নদীর তীরে অবস্থান করে কখনো নিরাহার, কখনো পরিমিত আহারের মাধ্যমে সংযম পালনপূর্বক পুষ্প, ধূপ ও হোমের মাধ্যমে নিত্য ‘দেবীসুক্ত’ পাঠপূর্বক দেবীর আরাধনা করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে পূজার নাম করে বিভিন্ন স্থানে রজঃ ও তমোগুণাশ্রয়ী অনাচারের যে প্রতিযোগিতা চলে, তাকে কোনো রুচিসম¥ত মানুষ পূজা বা আরাধনা বলবেন কিনা তাতে সন্দেহ থেকে যায়। আর এজন্যই ‘দুর্গাপূজা’র নামটি পরিবর্তিত হয়ে ‘দুর্গোৎসব’-এ পরিনত হয়েছে। তাই পূজার চেয়ে উৎসবের আমেজটাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। শাস্ত্রে অতসী পুষ্পের ন্যায় মুখাবরণ বিশিষ্টা মৃন্ময়ী দুর্গাদেবীর স্থান দখল করে নিয়েছে আধুনিক ও ফ্যাশনেবল প্রতিমা। ঢাক ও কাঁসরের বাঙালি সংস্কৃতিগত বাদ্যের স্থান দখল করেছে অশালীন হিন্দি-বাংলা রিমিক্স গান। এগুলো মাতৃভক্তির কেমন বহিঃপ্রকাশ তাদৃশ মাতৃভক্তরাই তা ভালো জানে। আরাধক ভক্তদের মহামায়াদেবী আয়ু, বিদ্যা, যশ, বুদ্ধি, দুর্গতিনাশ প্রভৃতি কাম্যবস্তু প্রদান করেন। কিন্তু তথাকথিত মাতৃভক্তদের কোন বাসনা দেবী মহামায়া পূরণ করবেন তা তিনিই জানেন। আবার ভগবদ্গীতার ভাষ্যানুযায়ী এসমস্ত সকাম কর্মীরাও কিন্তু বিভ্রান্ত। যথা,
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তে অন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া ॥
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া ॥
অর্থাৎ, জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে। (ভ.গী. ৭/২০)
আর এত তপস্যা করে তারা যে ফল প্রাপ্ত হয় সেটিও ক্ষণস্থায়ী। যথা, ‘অন্তুবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।’ (ভ.গী. ৭/২৩) অর্থাৎ, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ঐ ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দুর্গাদেবী প্রকৃতপক্ষে জড়জগৎরূপ কারাগারের অধ্যক্ষা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশেই তিনি এ কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি জীব কামনা বাসনার জালে আটকে পরে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে। সকাম কর্মই জগতে সমস্ত দুঃখের হেতু। তাই দেবীর কাছ থেকে সকাম কর্মীরা যা প্রাপ্ত হবেন সেটাও তাদের বন্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আবার ফিরে যাই সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যের প্রসঙ্গে- সুরথ রাজা স্বীয় রাজদরবারের বিশ্বাসঘাতক আমাত্যবর্গের দুষ্টচক্রে রাজ্যহারা হয়েছিলেন। তিনি ইতস্তত ভ্রমণ করতে করতে মেধা মুনির আশ্রমে এসে সমাধি বৈশ্যের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হন। সমাধি বৈশ্যও তদ্রূপ স্ত্রী-পুত্রাদি বান্ধব বিবর্জিত। পুত্রবধূদের কবলে পরে পুত্ররা তার সকল ধন হরণ করে নিয়ে নিঃসহায়-নিঃসম্বল অবস্থায় তাকে রাস্তায় বের করে দেয়। তখন উভয়ে মেধামুনির কাছে উপনীত হন। তখন মেধা মুনি তাদের বলেন, মহামায়ার প্রভাবেই সকল জীব কামনা-বাসনারূপ আবর্তময় মোহগর্তে নিপতিত হয়। সেই ভগবতী মহামায়াই জ্ঞানীদের চিত্ত বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহে নিক্ষেপ করেন। তখন মুনিবর তাদের মহামায়া দুর্গাদেবীর কথা সম্যকভাবে বলেন, যা এ জগতে ‘সপ্তশতী চণ্ডী’ নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু সপ্তশতী চণ্ডী শ্রবণ করেও সুরথ রাজার বিষয়বাসনা সর্বান্তঃকরণে নির্মূল হয়নি। তাই দেখা যায় তিনি তিন বছর কঠোর তপস্যা করে পুনরায় দুঃখের কারণ সেই রাজ্যভোগই কামনা করেছেন।
এ বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ২৩ নং শ্লোকে স্পষ্ট করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উল্লেখ করে দিয়েছেন, “অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার নিত্য পরম ধাম প্রাপ্ত হন।” যারা দুঃখালয় ও অশাশ্বত এ জড়জগৎ থেকে ভগবানের অপ্রাকৃত ধামে প্রত্যাবর্তন করতে চান, তাদের উচিত নিষ্ঠা সহকারে ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রদত্ত উপদেশ শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করা। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন,
আর এত তপস্যা করে তারা যে ফল প্রাপ্ত হয় সেটিও ক্ষণস্থায়ী। যথা, ‘অন্তুবত্তু ফলং তেষাং তদ্ ভবত্যল্পমেধসাম্।’ (ভ.গী. ৭/২৩) অর্থাৎ, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ঐ ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দুর্গাদেবী প্রকৃতপক্ষে জড়জগৎরূপ কারাগারের অধ্যক্ষা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশেই তিনি এ কর্মে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রতিটি জীব কামনা বাসনার জালে আটকে পরে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে। সকাম কর্মই জগতে সমস্ত দুঃখের হেতু। তাই দেবীর কাছ থেকে সকাম কর্মীরা যা প্রাপ্ত হবেন সেটাও তাদের বন্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
আবার ফিরে যাই সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্যের প্রসঙ্গে- সুরথ রাজা স্বীয় রাজদরবারের বিশ্বাসঘাতক আমাত্যবর্গের দুষ্টচক্রে রাজ্যহারা হয়েছিলেন। তিনি ইতস্তত ভ্রমণ করতে করতে মেধা মুনির আশ্রমে এসে সমাধি বৈশ্যের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হন। সমাধি বৈশ্যও তদ্রূপ স্ত্রী-পুত্রাদি বান্ধব বিবর্জিত। পুত্রবধূদের কবলে পরে পুত্ররা তার সকল ধন হরণ করে নিয়ে নিঃসহায়-নিঃসম্বল অবস্থায় তাকে রাস্তায় বের করে দেয়। তখন উভয়ে মেধামুনির কাছে উপনীত হন। তখন মেধা মুনি তাদের বলেন, মহামায়ার প্রভাবেই সকল জীব কামনা-বাসনারূপ আবর্তময় মোহগর্তে নিপতিত হয়। সেই ভগবতী মহামায়াই জ্ঞানীদের চিত্ত বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহে নিক্ষেপ করেন। তখন মুনিবর তাদের মহামায়া দুর্গাদেবীর কথা সম্যকভাবে বলেন, যা এ জগতে ‘সপ্তশতী চণ্ডী’ নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু সপ্তশতী চণ্ডী শ্রবণ করেও সুরথ রাজার বিষয়বাসনা সর্বান্তঃকরণে নির্মূল হয়নি। তাই দেখা যায় তিনি তিন বছর কঠোর তপস্যা করে পুনরায় দুঃখের কারণ সেই রাজ্যভোগই কামনা করেছেন।
এ বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সপ্তম অধ্যায়ের ২৩ নং শ্লোকে স্পষ্ট করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উল্লেখ করে দিয়েছেন, “অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের আরাধনা লব্ধ সেই ফল অস্থায়ী। দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, কিন্তু আমার ভক্তেরা আমার নিত্য পরম ধাম প্রাপ্ত হন।” যারা দুঃখালয় ও অশাশ্বত এ জড়জগৎ থেকে ভগবানের অপ্রাকৃত ধামে প্রত্যাবর্তন করতে চান, তাদের উচিত নিষ্ঠা সহকারে ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রদত্ত উপদেশ শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করা। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন,
মামুপেত্য পুনর্জন্ম দুঃখালয়মশাশ্বতম্।
নাপ্নুবন্তি মহাত্মনঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ ॥
নাপ্নুবন্তি মহাত্মনঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ ॥
অনুবাদ: হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থাৎ পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না। (ভ.গী ৮/১৬)
তাই নিজেদের কামনা-বাসনাপূর্তির কোনো প্রার্থনা নয়, দুর্গাদেবীর নিকট আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত তিনি যেন আমাদেরকে এ জড়জগতে পতিত হয়ে বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তনরূপ দুর্গতি সম্পূর্ণরূপে নাশ করেন। হরেকৃষ্ণ
তাই নিজেদের কামনা-বাসনাপূর্তির কোনো প্রার্থনা নয়, দুর্গাদেবীর নিকট আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত তিনি যেন আমাদেরকে এ জড়জগতে পতিত হয়ে বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তনরূপ দুর্গতি সম্পূর্ণরূপে নাশ করেন। হরেকৃষ্ণ
-রসিক কানাই দাস
Tags
Festival