শ্রীল শচীনন্দন স্বামী মহারাজ |
উদাহরণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন কারণ দ্রৌপদী একবার অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় আকুলভাবে ডেকেছিলেন ‘হে গোবিন্দ!’- বলে। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, দ্রৌপদীর এই প্রার্থনার জন্য আমি তার কাছে ঋণী। তার জন্য আমার এ অনুভূতি যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, “আমরা এটা ধারণা করতে পারি যে যখন কোনো ব্যক্তি নিরন্তর ভগবানকে স্মরণ করে এবং তাঁর শক্তিকে জপ করায় নিযুক্ত থাকে তখন সেই ব্যক্তির প্রতি পরমেশ্বর ভগবান কিরূপ বাধিত থাকেন। ভগবানের পক্ষে এরূপ ভক্তকে ভুলে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। কারণ এটা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে কেউ যখন ভগবানকে ডাকে তৎক্ষণাৎ সে ভগবানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর ভগবান সর্বদাই তাঁর প্রতি বাধিত থাকেন।” (ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, অ-২১)
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমি পা-বসেনা নামে একটি সংঘের আয়োজনে জীবনবৃক্ষ শিরোনামে এক সেমিনারে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে একটি চিত্রকর্ম আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ছবিতে দেখা যায় এক হতাশাগ্রস্থ বালিকা নিজ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষ মুহূর্তে পায়ের চোর ফেলে দেওয়ার আগে তার এক ভক্ত প্রতিবেশি বাইরে থেকে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে তার কাছে কিছু দুধ আছে কিনা, যা দিয়ে সে তার পূজা সম্পাদন করবে। বালিকাটি প্রতিবেশিকে তার খুশিমতো সবকিছু নিয়ে যেতে বলে, কেননা তার আর ওসবের প্রয়োজন নেই। ভক্ত প্রতিবেশীটি কৃতজ্ঞচিত্তে এক ঘড়া দুধ নিয়ে যায় এবং বলে যে তার পূজা সমাপ্ত হলে সে ফিরে এসে বালিকাটির সব কথা শুনবে এবং তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করবে।
যখন প্রতিবেশীটি চলে যায়, বেচারি বালিকাটি তখন পুনরায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন সে চেয়ার ফেলে দেয়, তখন সে আশ্চর্যজনকভাবে ভগবানের কোলে এসে পড়ে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মধুরস্বরে বালিকাটিকে বলে,
“যেহেতু তুমি আমার পূজায় দুধ দিয়ে সেবা করেছ, তাই আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আর এই কারণে আমি তোমাকে আমার চিন্ময় ধামে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি।”
এই চিত্রটি আমার হৃদয়কে গভীরভাবে আলাড়িত করে এবং একই সাথে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কতটি ঘটনার স্মৃতি আমার মনে ভেসে উঠে। সেসব ঘটনা যেখানে আমি ভগবানের অহৈতুকী কৃপার দর্শন পেয়েছিলাম।
শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন, “কৃতজ্ঞতা হলো মনের সেই অবস্থা যা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথকে সুগম করে।” কৃষ্ণভক্তগণ সেসমস্ত বিষয়াদির চিন্তা করে যা দিয়ে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। তাদের যেসকল জিনিস নেই বা যেসব আয়োজন তারা করে উঠতে পারে নি সেসকল বিষয়াদির চিন্তা তারা এড়িয়ে চলে। বরং যা কিছু অর্জিত হয়েছে, যে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে, যে যে সম্পর্কগুলো স্থাপনে সক্ষম হয়েছে,- সেসকল ব্যপারে ভক্তগণ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। সর্বোপরি আত্মউপলব্ধির সুযোগ পাওয়ার জন্য এই অনন্য মানবজীবন পেয়ে ভক্তগণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এভাবেই প্রত্যেকটি নতুন সকালে তারা নিজেদের কৃতজ্ঞতার উষ্ণপাশে ভরে তুলে অধিক শক্তিশালী করে তোলে।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দুটি সুবিধা আছে। প্রথমত, আপনার যা কিছু আছে সেসব ব্যাপারে আপনি সচেতন হয়ে উঠবেন। দ্বিতীয়ত, যেসকল মানুষদের প্রতি আপনি কৃতজ্ঞতা অনুভব করবেন, তাদের সাথে আপনি যুক্ত হবেন। আপনাদের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, যেসব বিষয়ের প্রতি আপনি কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে পারেন, সেসব বিষয়ের তালিকা মনে মনে প্রতিদিন তৈরি করুন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-
‘আমি আজকের দিনে কাজ করার এবং নিজেকে উন্নত করার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ। আমাকে এই পবিত্র নাম, প্রদান করার জন্য আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞ। ইত্যাদি....”আপনি তৎক্ষণাৎ অনুভব করবেন যে আপনার হৃদয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি কি পরিমাণ প্রসারিত হয়েছে।
প্রায় আমরা লক্ষ্য করি না কি বিশাল সুযোগ আমাদের দেওয়া হয়েছে। আমরা সেগুলো দেখি কিন্তু সেই সুযোগগুলোকে আমরা উপলব্ধি বা স্বীকার করি না। আমরা আমাদের প্রাপ্ত সুযোগসমূহের প্রতি অন্ধ। এটি খুবই ভয়াবহ। কৃতজ্ঞতা অনুভব আমাদের জীবনকে ফিরে দেখতে এবং সম্ভবত তাকে শুরু থেকে আবিষ্কারে সাহায্য করে।
একজন প্রকৃত ভক্ত কতখানি কৃতজ্ঞ থাকেন সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করে শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর বলেছেন যে: যদি একজন ভক্ত এমনকি হাজার ব্রহ্মাণ্ডের সকল সৃষ্টি দিয়েও ভগবানের সেবা করে, তবু সে পরমপ্রভুর শ্রীপাদপদ্মের সেবা করার সুযোগ লাভের প্রতিদান দিতে নিজেকে অপারগ মনে করে থাকে।”