শ্রীপাদ জননিবাস প্রভু |
অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসে আত্মীয়বর্গকে দেখে যুদ্ধ করতে চাচ্ছিলেন না। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছিলেন যে, মহান মহান গুরুতুল্য আত্মীয় সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের সাথে যুদ্ধ করে তাঁদের রক্তে রঞ্জিত সাম্রাজ্য ভোগ করে আমার জীবনে কোনও সুখ-শান্তি পেতে পারব না। আমি যুদ্ধ চাই না, বরং তারা সবাই যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা আমাকে মেরে ফেলুক- আমার দুঃখ নেই। বরং ভিক্ষুক হয়ে অন্যত্র গিয়ে জীবন কাটানো শ্রেয়স্কর। এই যুদ্ধের ফলে বহু নারী পতিহীন হবে। এ সকল মহাত্মা বীর সমাজের নারী ও বালকদের উপদেষ্টারূপে কাজ করে। তারা যখন যুদ্ধে প্রাণ দিবে তখন সমস্ত সমাজ বিধর্মী ভাবধারায় চলতে থাকবে। বর্ণসংকর প্রজাতির সৃষ্টি হবে। অনাচার-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধিযোগে কর্ম করতে হয়। কর্ম ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। মুহূর্তের জন্যেও নিষ্কর্মা হয়ে থাকা উচিত নয়। হে অর্জুন, তুমি এমন অভিজ্ঞ যোগী নও যে, বসে বসে ইন্দ্রিয় সংযম তথা মনস্থির হয়ে জীবন কাটাতে পারবে।
মনোসংযমের ফলে যখন মানুষের মন স্থির হয়, তখন তার কর্তব্য-অকর্তব্য উপলব্ধি হয়। মনকে স্থির রাখার নামই ধ্যান। যোগীরা বসে বসে পরমাত্মার ধ্যান করতেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধ্যান করতে বলেন নি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় সেনাপতি অর্জুনের কতর্ব্য যুদ্ধ করা। যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধ না করার এই মনোভাব ভালো নয়। অর্জুন যদি শান্তির জন্য যুদ্ধ ত্যাগ করে বনে চলে যান; আর ধ্যানও করতে থাকেন, তাহলেও স্বভাবতই তিনি পরমাত্মার বা ভগবানের ধ্যান না করে তাঁর ভাইদের কথা, দুর্যোধনের অত্যাচারের কথা চিন্তা করতে থাকবেন। ভগবানের চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর শত্রুপক্ষের কথাই স্মরণ হবে। মন বেশি বিক্ষুব্ধ হবে। আর সমস্ত বীরপুরুষেরা এমনকি নারীরাও অর্জুনের ন্যায় বীর সেনাপতিকে নিন্দা ও উপহাস করতে থাকবে। এর ফলে অর্জুনের মন আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্যই তৈরি হবে। অতএব যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ভিক্ষুক হয়েও মনে শান্তি পাবেন না।
শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, হে অর্জুন তুমি পরম যোগী হও। তোমার জাগতিক কর্ম সম্পাদন কর এবং সর্বদা আমার স্মরণ নাও। কোথাও পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের কোনো অবস্থার পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে কৃষ্ণচিন্তা করা। আমাদের নিজ নিজ অবস্থার মধ্যে সর্বদাই কৃষ্ণকে চিন্তা করতে হবে। যেখানেই থাকুন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তনাদি করতেই হবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, অর্জুন যেন রণাঙ্গনেই প্রবৃত্ত থাকেন এবং এভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেই পারমার্থিক পথে অগ্রসর হতে পারেন। শত্রুপক্ষের লক্ষ লক্ষ বাণ আসছে, সে সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশেই আমি যুদ্ধ করব, সেই মনোভাব থাকবে।
জগতে প্রত্যেকের স্বভাব এক নয়, স্বভাব অনুসারে লোকে কর্ম করে। ক্ষত্রিয় স্বভাব মানেই তার যুদ্ধ করার প্রবণতা প্রবল। তার মনে ক্রোধভাব থাকে, তাকে যুদ্ধ করতে হয়। আমরা জানি ক্রোধ ভালো গুণ নয়, ক্রোধকে সংযত করতে হয়। কিন্তু অর্জুন যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে যুদ্ধ করছিলেন, তাই সেই যুদ্ধকর্মের মাধ্যমেই তিনি পারমার্থিক সিদ্ধি লাভ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত কর্ম প্রবণতা, সমস্ত গুণ কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করতে হবে। অর্জুন তাঁর ক্ষাত্রভাব কৃষ্ণসেবায় নিয়োগ করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানের খাতিরেই অর্জুন তার কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তাই সেই কর্মটি অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়। আমাদের কর্মগুলো যখন কেবল জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উদ্দেশ্যেই করা হয়, তখন সেটি এক সময় দুঃখ শোকের কারণ হয়ে দাড়াঁয়। কিন্তু সেই সমস্ত কর্ম, কৃষ্ণপ্রীতির উদ্দেশ্যে করা হলে তা অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়। সে কর্মযোগের কথাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে। ক্রোধ স্বভাবটি ভালো বিষয় না হতে পারে, কিন্তু রামভক্ত হনুমান সীতা অপহরণকারী রাবণের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে লঙ্কা নগরী পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, শ্রীরামচন্দ্রকে খুশি করার জন্য। সেই ক্রোধটিও ভক্তি। সমস্ত গুণগুলো ভগবৎপ্রীতির উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদিত হলেই আমাদের পারমার্থিক কল্যাণ সাধিত হয়। আমাদের অবস্থান পরিবর্তনের দরকার নেই। কেবল চেতনার পরিবর্তনের দরকার আছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, ‘গৃহে থাকো, বনে থাকো, সদা হরি বলে ডাকো।’ যে অবস্থায় থাকি না কেন, শ্রীহরির প্রীতির উদ্দেশ্যেই জীবন ধারণ করতে হবে। যেটি এ জগতে ‘আমার জন্য’ করা হচ্ছে, সেটি বাদ দিয়ে ‘কৃষ্ণের জন্য’ করতে হবে। প্রীতিভরে কৃষ্ণসেবা করলে, কৃষ্ণ সেই সেবা প্রীতিভরেই গ্রহণ করেন।
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী বলেছেন, কোনো কোনো ব্যক্তি সুখ পাচ্ছে না ফলে সুখ পাওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যত্র যায়। ‘সুখী হব’ এ চিন্তায় গৃহত্যাগ করে হিমালয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়। কারণ তার মনে নিজের সুখ পাওয়ার চিন্তা রয়েছে। অর্জুন ভাবছিলেন, যুদ্ধ সমস্যা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলেই সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সমস্যা থেকেই যাবে। সমস্যার চিন্তা তাঁকে ছাড়বে না।
শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে বলেছেন, প্রত্যেকের কিছু ইন্দ্রিয় সুখের প্রয়োজন থাকে। তাই বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসারে ভগবানের নির্দেশ অনুসারে চলা তাদের কর্তব্য। আমরা যদি সমাজ, ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি চাই- তাহলে বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসরণ করে চলতে হবে। সুষ্ঠুভাবে সেই পন্থা অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা জাগতিক সুখ লাভ করতে পারব এবং পারমার্থিক দিকেও এগিয়ে চলতে পারব। বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করে চিত্তশুদ্ধি লাভ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিচ্ছেন। যোগ ধর্ম তপস্যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। সপ্তম অধ্যায়ে ২৮ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, হে অর্জুন পূর্ব জন্মে বহু পুণ্যকর্মফলে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হয়েছ। তুমি আমার নিত্য সেবক।
সব ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শুদ্ধতা লাভ করা। ফলে কৃষ্ণসেবক হওয়ার সুযোগ লাভ হবে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বহু বহু জন্মের পর শুদ্ধতা লাভের ফলে কেউ বুঝতে পারে যে, ভগবান বাসুদেব সবকিছুর কারণ। সহস্র সহস্র জন্ম সদাচার করার ফলে কেউ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যার পুণ্যকর্ম করার ক্ষমতা ছিল কিন্তু সে করল না, কেবল তা চিন্তা করল মাত্র, এতে কোনো সুফল লাভ হয় না। এভাবে নিজেকে প্রতারণা করা উচিত নয়। কেউ জানেনা কীভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়। প্রত্যেকেই পাপকর্ম করতে চায়। তাই শুদ্ধতা লাভ করা অসম্ভব। ভগবান ভক্তরূপে স্বয়ং এসে শিক্ষা দিলেন কীভাবে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কেবল ভগবানের নামগ্রহণের মাধ্যমে আমরা শুদ্ধি লাভ করতে পারি ও তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করতে পারি। মহাপ্রভু বলেছেন- তোমাদের কোনো পুণ্য নেই, তাই তোমাদের যোগ্যতা বিচার করি না। আমি যুগধর্ম স্থাপন করছি। সেটি গ্রহণ করলেই ভগবৎচরণে আত্মসমর্পণ হয়ে যায়। অত্যন্ত কৃপাময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগতে নাম রূপে অবতীর্ণ হয়ে সবার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মহাবদান্য মহাপ্রভু ব্রহ্মারও দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম যেচে যেচে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এটি তাঁর অহৈতুকী কৃপা। সেই কৃপা পেতে হলে পাপ প্রবণতা ছাড়তে হবে। মহাপ্রভু বলছেন, যা দিচ্ছি, তা যদি নাও, তবে বহু বহু জন্ম এক মুহূর্তেই পার হয়ে যাবে।
পাপ ছেড়ে হরিনাম করতে থাকলে ক্রমশ কৃষ্ণভক্তির দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। এমন কোনো পাপ নেই যা জগাই-মাধাই করেনি। শুধু তাই নয়, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় তারা ভীষণ ভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তবুও তাদের হরিনাম দিয়ে কৃপা করলেন। এভাবে তাদের বহুদিনের অসংখ্য পাপরাশি মুছে গেল। এটি গৌরনিতাইয়ের অভাবনীয় অহৈতুকী কৃপা। পাশ্চাত্যের মানুষ কি-ই বা পাপ না করে। কিন্তু তারা শ্রীল প্রভুপাদের সংস্পর্শে এসেই হরিনাম করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হচ্ছে। শ্রীল প্রভুপাদ মহাপ্রভুর কৃপা বিলিয়েছেন। কোটি কোটি জন্ম ধরে আমরা ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের চিন্তা করে এসেছি। সেই চিন্তা করা ছাড়তে হবে। হরিনাম করছি, ইন্দ্রিয়তর্পণের চিন্তা করছি- সেটি আত্ম প্রতারণা। তাহলে বহুদূর পিছিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা যদি প্রতারণা করি, তবে কৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তগণ কখনও প্রীত হবেন না। এমনকি কখনও শ্রীকৃষ্ণ আমাদের কাছে প্রকাশিতও হবেন না। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সামনে অবতীর্ণ হয়েছেন। আমরা যদি তাঁকে ফাঁকি দেই তবে আমাদের শাস্তি-দুর্ভোগ পেতে হবে। যেমন ছোট্ট শিলারূপে শালগ্রাম রয়েছেন। তুলসী ও জল পাওয়া যায়। কেউ ভক্তিভরে তুলসীপাতা ও জল দিয়ে অনায়াসে পূজা করতে পারেন। কিন্তু শালগ্রামের যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। তখন কৃষ্ণ প্রীত হবেন না। ফলে প্রকৃত শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধিযোগে কর্ম করতে হয়। কর্ম ছাড়া কেউ থাকতে পারে না। মুহূর্তের জন্যেও নিষ্কর্মা হয়ে থাকা উচিত নয়। হে অর্জুন, তুমি এমন অভিজ্ঞ যোগী নও যে, বসে বসে ইন্দ্রিয় সংযম তথা মনস্থির হয়ে জীবন কাটাতে পারবে।
মনোসংযমের ফলে যখন মানুষের মন স্থির হয়, তখন তার কর্তব্য-অকর্তব্য উপলব্ধি হয়। মনকে স্থির রাখার নামই ধ্যান। যোগীরা বসে বসে পরমাত্মার ধ্যান করতেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধ্যান করতে বলেন নি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় সেনাপতি অর্জুনের কতর্ব্য যুদ্ধ করা। যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধ না করার এই মনোভাব ভালো নয়। অর্জুন যদি শান্তির জন্য যুদ্ধ ত্যাগ করে বনে চলে যান; আর ধ্যানও করতে থাকেন, তাহলেও স্বভাবতই তিনি পরমাত্মার বা ভগবানের ধ্যান না করে তাঁর ভাইদের কথা, দুর্যোধনের অত্যাচারের কথা চিন্তা করতে থাকবেন। ভগবানের চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর শত্রুপক্ষের কথাই স্মরণ হবে। মন বেশি বিক্ষুব্ধ হবে। আর সমস্ত বীরপুরুষেরা এমনকি নারীরাও অর্জুনের ন্যায় বীর সেনাপতিকে নিন্দা ও উপহাস করতে থাকবে। এর ফলে অর্জুনের মন আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্যই তৈরি হবে। অতএব যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে ভিক্ষুক হয়েও মনে শান্তি পাবেন না।
শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, হে অর্জুন তুমি পরম যোগী হও। তোমার জাগতিক কর্ম সম্পাদন কর এবং সর্বদা আমার স্মরণ নাও। কোথাও পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের কোনো অবস্থার পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে কৃষ্ণচিন্তা করা। আমাদের নিজ নিজ অবস্থার মধ্যে সর্বদাই কৃষ্ণকে চিন্তা করতে হবে। যেখানেই থাকুন হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তনাদি করতেই হবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, অর্জুন যেন রণাঙ্গনেই প্রবৃত্ত থাকেন এবং এভাবেই যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেই পারমার্থিক পথে অগ্রসর হতে পারেন। শত্রুপক্ষের লক্ষ লক্ষ বাণ আসছে, সে সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। সেই সঙ্গে পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশেই আমি যুদ্ধ করব, সেই মনোভাব থাকবে।
জগতে প্রত্যেকের স্বভাব এক নয়, স্বভাব অনুসারে লোকে কর্ম করে। ক্ষত্রিয় স্বভাব মানেই তার যুদ্ধ করার প্রবণতা প্রবল। তার মনে ক্রোধভাব থাকে, তাকে যুদ্ধ করতে হয়। আমরা জানি ক্রোধ ভালো গুণ নয়, ক্রোধকে সংযত করতে হয়। কিন্তু অর্জুন যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে যুদ্ধ করছিলেন, তাই সেই যুদ্ধকর্মের মাধ্যমেই তিনি পারমার্থিক সিদ্ধি লাভ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের সমস্ত কর্ম প্রবণতা, সমস্ত গুণ কৃষ্ণসেবায় নিযুক্ত করতে হবে। অর্জুন তাঁর ক্ষাত্রভাব কৃষ্ণসেবায় নিয়োগ করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিবিধানের খাতিরেই অর্জুন তার কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, তাই সেই কর্মটি অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়। আমাদের কর্মগুলো যখন কেবল জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উদ্দেশ্যেই করা হয়, তখন সেটি এক সময় দুঃখ শোকের কারণ হয়ে দাড়াঁয়। কিন্তু সেই সমস্ত কর্ম, কৃষ্ণপ্রীতির উদ্দেশ্যে করা হলে তা অপ্রাকৃত কর্মে রূপান্তরিত হয়। সে কর্মযোগের কথাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে। ক্রোধ স্বভাবটি ভালো বিষয় না হতে পারে, কিন্তু রামভক্ত হনুমান সীতা অপহরণকারী রাবণের প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে লঙ্কা নগরী পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, শ্রীরামচন্দ্রকে খুশি করার জন্য। সেই ক্রোধটিও ভক্তি। সমস্ত গুণগুলো ভগবৎপ্রীতির উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পাদিত হলেই আমাদের পারমার্থিক কল্যাণ সাধিত হয়। আমাদের অবস্থান পরিবর্তনের দরকার নেই। কেবল চেতনার পরিবর্তনের দরকার আছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন, ‘গৃহে থাকো, বনে থাকো, সদা হরি বলে ডাকো।’ যে অবস্থায় থাকি না কেন, শ্রীহরির প্রীতির উদ্দেশ্যেই জীবন ধারণ করতে হবে। যেটি এ জগতে ‘আমার জন্য’ করা হচ্ছে, সেটি বাদ দিয়ে ‘কৃষ্ণের জন্য’ করতে হবে। প্রীতিভরে কৃষ্ণসেবা করলে, কৃষ্ণ সেই সেবা প্রীতিভরেই গ্রহণ করেন।
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী বলেছেন, কোনো কোনো ব্যক্তি সুখ পাচ্ছে না ফলে সুখ পাওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যত্র যায়। ‘সুখী হব’ এ চিন্তায় গৃহত্যাগ করে হিমালয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়। কারণ তার মনে নিজের সুখ পাওয়ার চিন্তা রয়েছে। অর্জুন ভাবছিলেন, যুদ্ধ সমস্যা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেলেই সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সমস্যা থেকেই যাবে। সমস্যার চিন্তা তাঁকে ছাড়বে না।
শ্রীল প্রভুপাদ তাৎপর্যে বলেছেন, প্রত্যেকের কিছু ইন্দ্রিয় সুখের প্রয়োজন থাকে। তাই বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসারে ভগবানের নির্দেশ অনুসারে চলা তাদের কর্তব্য। আমরা যদি সমাজ, ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি চাই- তাহলে বর্ণাশ্রম পন্থা অনুসরণ করে চলতে হবে। সুষ্ঠুভাবে সেই পন্থা অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা জাগতিক সুখ লাভ করতে পারব এবং পারমার্থিক দিকেও এগিয়ে চলতে পারব। বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করে চিত্তশুদ্ধি লাভ করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিচ্ছেন। যোগ ধর্ম তপস্যার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মশুদ্ধি। সপ্তম অধ্যায়ে ২৮ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, হে অর্জুন পূর্ব জন্মে বহু পুণ্যকর্মফলে তুমি আমাকে প্রাপ্ত হয়েছ। তুমি আমার নিত্য সেবক।
সব ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে শুদ্ধতা লাভ করা। ফলে কৃষ্ণসেবক হওয়ার সুযোগ লাভ হবে। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বহু বহু জন্মের পর শুদ্ধতা লাভের ফলে কেউ বুঝতে পারে যে, ভগবান বাসুদেব সবকিছুর কারণ। সহস্র সহস্র জন্ম সদাচার করার ফলে কেউ কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যার পুণ্যকর্ম করার ক্ষমতা ছিল কিন্তু সে করল না, কেবল তা চিন্তা করল মাত্র, এতে কোনো সুফল লাভ হয় না। এভাবে নিজেকে প্রতারণা করা উচিত নয়। কেউ জানেনা কীভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়। প্রত্যেকেই পাপকর্ম করতে চায়। তাই শুদ্ধতা লাভ করা অসম্ভব। ভগবান ভক্তরূপে স্বয়ং এসে শিক্ষা দিলেন কীভাবে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করতে হয়। কেবল ভগবানের নামগ্রহণের মাধ্যমে আমরা শুদ্ধি লাভ করতে পারি ও তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করতে পারি। মহাপ্রভু বলেছেন- তোমাদের কোনো পুণ্য নেই, তাই তোমাদের যোগ্যতা বিচার করি না। আমি যুগধর্ম স্থাপন করছি। সেটি গ্রহণ করলেই ভগবৎচরণে আত্মসমর্পণ হয়ে যায়। অত্যন্ত কৃপাময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগতে নাম রূপে অবতীর্ণ হয়ে সবার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। মহাবদান্য মহাপ্রভু ব্রহ্মারও দুর্লভ কৃষ্ণপ্রেম যেচে যেচে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এটি তাঁর অহৈতুকী কৃপা। সেই কৃপা পেতে হলে পাপ প্রবণতা ছাড়তে হবে। মহাপ্রভু বলছেন, যা দিচ্ছি, তা যদি নাও, তবে বহু বহু জন্ম এক মুহূর্তেই পার হয়ে যাবে।
পাপ ছেড়ে হরিনাম করতে থাকলে ক্রমশ কৃষ্ণভক্তির দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। এমন কোনো পাপ নেই যা জগাই-মাধাই করেনি। শুধু তাই নয়, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মাথায় তারা ভীষণ ভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তবুও তাদের হরিনাম দিয়ে কৃপা করলেন। এভাবে তাদের বহুদিনের অসংখ্য পাপরাশি মুছে গেল। এটি গৌরনিতাইয়ের অভাবনীয় অহৈতুকী কৃপা। পাশ্চাত্যের মানুষ কি-ই বা পাপ না করে। কিন্তু তারা শ্রীল প্রভুপাদের সংস্পর্শে এসেই হরিনাম করার মাধ্যমে পাপমুক্ত হচ্ছে। শ্রীল প্রভুপাদ মহাপ্রভুর কৃপা বিলিয়েছেন। কোটি কোটি জন্ম ধরে আমরা ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের চিন্তা করে এসেছি। সেই চিন্তা করা ছাড়তে হবে। হরিনাম করছি, ইন্দ্রিয়তর্পণের চিন্তা করছি- সেটি আত্ম প্রতারণা। তাহলে বহুদূর পিছিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা যদি প্রতারণা করি, তবে কৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তগণ কখনও প্রীত হবেন না। এমনকি কখনও শ্রীকৃষ্ণ আমাদের কাছে প্রকাশিতও হবেন না। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সামনে অবতীর্ণ হয়েছেন। আমরা যদি তাঁকে ফাঁকি দেই তবে আমাদের শাস্তি-দুর্ভোগ পেতে হবে। যেমন ছোট্ট শিলারূপে শালগ্রাম রয়েছেন। তুলসী ও জল পাওয়া যায়। কেউ ভক্তিভরে তুলসীপাতা ও জল দিয়ে অনায়াসে পূজা করতে পারেন। কিন্তু শালগ্রামের যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। তখন কৃষ্ণ প্রীত হবেন না। ফলে প্রকৃত শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
Tags
সমাচার