বৈষ্ণব জীবনে শ্রীনৃসিংহদেব

hksamacar
আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যে শ্রীনৃসিংহদেব এক বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আমরা শ্রীনৃসিংহদেবের আরাধনা করি এজন্যই যে, যাতে আমরা জড় বাসনাগুলো থেকে মুক্ত হয়ে শ্রীশ্রী রাধা-গোবিন্দের পাদপদ্মে যথার্থভাবে সেবা করতে পারি। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে শ্রীল প্রভুপাদ ইস্কনে, তাঁর সকল মন্দিরের প্রভাতী অনুষ্ঠানে মঙ্গলারতির অংশরূপে শ্রীনৃসিংহ-বন্দনার প্রবর্তন করেছেন। শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দের সেবায় শ্রীমতী তুলসী দেবীর দাসীরূপে আমাদের নিযুক্ত করবার প্রার্থনা, শ্রীমতী তুলসীদেবীর কাছে করবার ঠিক আগে প্রতিদিন আমরা শ্রীনৃসিংহদেবের আরাধনা করি। আসুরিক কামনামুক্ত এক শুদ্ধহৃদয় ব্যতীত সেই দিব্য-যুগল রূপ শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের দাসীরূপে নিযুক্ত হওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও সাধারণত আমরা পরমেশ্বর ভগবানের বিভিন্ন অবতারের আরাধনায় আগ্রহী নই, তবু শ্রীনৃসিংহদেবের আরাধনা হৃদয়স্থ দানবকে বধ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/১৮/৮) প্রহ্লাদ মহারাজ প্রার্থনা করেছেন-
ওঁ নমো ভগবতে নরসিংহায়
নমস্তেজস্তেজসে আবিরাবির্ভব
বজ্রনখ বজ্রদংষ্ট্র কর্মাশয়ান্
রন্ধয় রন্ধয় তমো গ্রস গ্রস ওঁ স্বাহা
অভয়মভয়াত্মনি ভূয়িষ্ঠা ওঁ ক্ষ্রৌম্ ॥
অর্থাৎ “সমস্ত তেজের উৎস ভগবান নৃসিংহদেবকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। হে ভগবান আপনার নখ এবং আপনার দন্ত বজ্রের মতো, দয়া করে আপনি আমাদের সমস্ত আসুরিক কর্মবাসনার বিনাশ করুন। দয়া করে আপনি আমাদের হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে, আমাদের সমস্ত অজ্ঞান দূর করুন যাতে আপনার কৃপায় আমরা জীবন সংগ্রামে নির্ভীক হতে পারি।”
এই শ্লোকটির তাৎপর্যাংশে শ্রীল প্রভুপাদ বর্ণনা করেছেন, “অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার থেকে উৎপন্ন জড়-জাগতিক বাসনা থেকে জীব যতক্ষণ মুক্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ভগবানের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হতে পারে না। তাই জড়বাসনার মূর্ত প্রতীক হিরণ্যকশিপুর সংহারকারী ভগবান নৃসিংহদেবের প্রার্থনা আমাদের সর্বদা করা উচিত। হিরণ্য মানে সোনা এবং কশিপু মানে কোমল আসন বা শয্যা। বিষয়াসক্ত মানুষ সর্বদা তাদের দেহের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করে এবং তাই তাদের প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণের প্রয়োজন হয়। সেই সূত্রে হিরণ্যকশিপু জড়-জাগতিক জীবনের আদর্শ প্রতীক। তাই সে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবদ্ভক্ত প্রহ্লাদ মহারাজের প্রচুর বিড়ম্বনার কারণ হয়েছিল। অবশেষে ভগবান নৃসিংহদেব এসে তাকে সংহার করেন। যে ভক্ত জড় বাসনা থেকে মুক্ত হতে চান, তার কর্তব্য হচ্ছে এই শ্লোকে প্রহ্লাদ মহারাজ যেভাবে নৃসিংহদেবের প্রার্থনা করেছেন, সেইভাবে প্রার্থনা করা। এই তত্ত্বটি শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর সুন্দরভাবে তাঁর ‘নবদ্বীপ ভাব তরঙ্গ’-এ ব্যাখ্যা করেছেন (শ্লোক ৩৬-৪০)
এ দুষ্ট হৃদয়ে কাম আদি রিপু ছয়।
কুটিনাটি প্রতিষ্ঠাশা শাঠ্য সদা রয় ॥
হৃদয় শোধন আর কৃষ্ণের বাসনা।
নৃসিংহচরণে মোর এই তো কামনা ॥
“আমার এই পাপময় হৃদয়ে কাম ইত্যাদি ষড় রিপু রূপ ছয়টি শত্রু সর্বদা বসবাস করছে। সেই সঙ্গে কপটতা, যশ আকাক্সক্ষা ও নির্ভেজাল কুটিলতাও রয়েছে। শ্রীনৃসিংহদেবের পাদপদ্মে আমি এই প্রপত্তি করি যে কৃপা করে তিনি আমার হৃদয়কে শুদ্ধ করুন এবং আমাকে শ্রীকৃষ্ণের সেবা বাসনা প্রদান করুন।”
কান্দিয়া নৃসিংহ পদে মাগিব কখন।
নিরাপদে নবদ্বীপে যুগল-ভজন ॥
ভয়, ভয় পায় যার দর্শনে, সে হরি।
প্রসন্ন হইবে কবে মোরে দয়া করি ॥
“কাঁদতে কাঁদতে আমি শ্রীনৃসিংহদেবের চরণ কমলে, সকল বাধা বিঘ্ন থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদে নবদ্বীপে শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণ ভজনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করব। যাঁর ভয়ঙ্কর রূপ স্বয়ং ভয়েরও ভয় উৎপন্ন করে সেই ভগবান হরি কবে আমার উপর প্রসন্ন হবেন এবং আমাকে কৃপা প্রদর্শন করবেন?”
যদ্যপি ভীষণ মূর্তি দুষ্ট জীব প্রতি।
প্রহ্লাদাদি কৃষ্ণভক্তজনে ভদ্র অতি ॥
কবে বা প্রসন্ন হইয়া সকৃপ বচনে।
নির্ভয় করিবে এই মূঢ় অকিঞ্চনে ॥
“এমনকি যদিও শ্রীনৃসিংহদেব কপট আত্মাদের প্রতি ভয়ঙ্কর, কিন্তু তিনি প্রহ্লাদ মহারাজ প্রমুখ অন্যান্য কৃষ্ণভক্তকে পরম শুভময়তা প্রদান করেন। কবে তিনি আমার মতো এক মূর্খ অকিঞ্চনকে কৃপা বচন প্রদান করে আমাকে ভয়মুক্ত করবেন?”
স্বচ্ছন্দে বৈস হে বৎস শ্রীগৌরাঙ্গধামে।
যুগল-ভজন হউ রতি হউ নামে ॥
মম ভক্ত কৃপা-বলে বিঘ্ন যাবে দূর।
শুদ্ধ চিতে ভজ রাধাকৃষ্ণ-রস-পুর ॥
“তিনি বলবেন, ‘হে বৎস, নির্ভয়ে বসে থাকো এবং এখানেই এই শ্রীগৌরাঙ্গ ধামে সুখে বাস কর। শ্রীশ্রীরাধা-কৃষ্ণের সুন্দর আরাধনার মাধ্যমে, তাঁদের পবিত্র নামের প্রতি তোমার প্রেমময় আসক্তির বিকাশ হোক। আমার ভক্তগণের কৃপায়, সকল বাধাবিঘ্ন দূরে চলে যায়। শুদ্ধ চিত্তে কেবল শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের ভজনা কর, কেননা এই ভজনা সুমিষ্ট অমৃতে ভরপুর’।”
এই বলি কবে মোর মস্তক উপর।
স্বীয় শ্রীচরণ হর্ষে ধরিবে ঈশ্বর ॥
অমনি যুগল-প্রেমে সাত্ত্বিক বিকারে।
ধরায় লুটিব আমি শ্রীনৃসিংহ-দ্বারে ॥
“এই কথা বলে, কবে ভগবান তাঁর স্বীয় দিব্য পাদপদ্ম সানন্দে আমার মস্তকে স্থাপন করবেন? আমি শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের জন্য সশ্রদ্ধ প্রেম লাভ করব আর তার ফলে সাত্ত্বিক নামক দিব্য বিকার-প্রাপ্ত হয়ে শ্রীনৃসিংহ মন্দিরের দ্বারে পতিত হয়ে গড়াগড়ি দেব।”

জয়, ভক্তি পথের সকল বিঘ্নবিনাশকারী শ্রীনৃসিংহদেব কি জয়!
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ আরাধনায় শুদ্ধ প্রেম প্রদানকারী শ্রীনৃসিংহদেব কি জয়!
গৌরাঙ্গ কিশোর দাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন