দূর্ভাগ্য সহনের স্তর -শ্রীচৈতন্য চরণ দাস ব্রহ্মচারী

খলভাতো দিবসেশ্বরস্য কিরণৈর্সন্তপিতে মস্তকে
বঞ্চন দেশং অনতপং বিধিবশত তালস্য মূলং গত।
তত্রাপি অস্য মহাফলেনা পতত ভগ্নং সশব্দং
শির প্রায় গচ্ছতি যাত্রা ভাগ্যরহিতঃ তত্রৈব যান্তি আপদ ॥

খলভাতো- টাকমাথা ব্যক্তি; দিবসেশ্বরস্য- সূর্যের; কিরণৈঃ- কিরণ দ্বারা; সন্তপিতে- দগ্ধ অনুভব করা; মস্তকে- মাথায়; বঞ্চন- অভিলাষ; দেশম্- স্থান; অনতপম্- তাপরহিত; বিধিবশতঃ- ভাগ্য অনুসারে; তালস্য- তালগাছের; মূলম্- নিচে; গত- যায়; তত্রাপি- সেখানেও; অস্য- তার; মহাফলেনা- বড় তাল; পতত- পড়ে গিয়ে; ভগ্নম্- ভেঙে যাওয়া; সশব্দম্- সশব্দে; শিরঃ- মাথা; প্রায়- সাধারণত; গচ্ছতি- যায়; যাত্রা- যত্রতত্র; ভাগ্যরহিতঃ- দুর্ভাগা ব্যক্তি; তত্রৈব- সেখানেও; যান্তি- যায়; আপদ- ভাগ্য বিড়ম্বনা।
hksamacar-bad-luck

একজন কেশহীন ব্যক্তি সূর্যের তাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন। তিনি তাপ থেকে মুক্তি পেতে ভাগ্যক্রমে একটি তালগাছের নিচে আশ্রয় খুঁজে পেলেন। এই কষ্ট থেক মুক্তি পেলেও, তা মাথায় একটি বড় তাল সশব্দে পড়ে ভেঙে গেল। বস্তুত একজন দুর্ভাগা ব্যক্তি যেদিকে যায়, দুর্ভাগ্যও তাকে অনুসরণ করে। (নীতিশতক ভর্তৃহরি শ্লোক ১০)
কখন কখনও আমরা এমন দুর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে যাই, যখন একের পর এক বিড়ম্বনা দেখা দেয়। যখনই আমরা কোনো কিছু ঠিক করতে যাই, তখনই সেটি আরও খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। গীতার জ্ঞান আমাদের বোঝাতে সাহায্য করে যে, এ সময়গুলো আমাদেরকে আমাদের অতীত কর্মেও সঞ্চিত কর্মফল থেকে মুক্ত করে। এ সময়গুলো থেকে পার হওয়ার জন্য অথবা শুধু জীবিত থাকার জন্য আমাদের ধৈর্য এবং সহ্যের প্রয়োজন। অধিক উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিকে অধিকতর খারাপ করে, এমনকি ধ্বংসও হতে পারে।
এর অর্থ কি এই যে, আমরা পরিস্থিতিকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেব এবং কোনো সমাধানের চেষ্টা করব না? হ্যাঁ, বৈদিক ঐতিহ্য অদৃষ্টবাদী ছিল না। উদাহরণস্বরূপ এই ঐতিহ্য কখনোই একজন অসুস্থ মানুষকে বলে না যে, তুমি শুধু তোমার যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকো; বরং অত্যন্ত সমৃদ্ধ চিকিৎসা-বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদেও মাধ্যমে তার আরোগ্যের ব্যবস্থা করে।
তথাপি সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য অত্যন্ত বাস্তবতার সঙ্গে এটি স্বীকার করে যে, কখনো কখনো আমাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনো কিছুই কাজ করে না। এই সময়গুলোতে উন্মুক্ত কাজ অপেক্ষা দার্শনিক চিন্তাভাবনা করা শ্রেয়। এ চিন্তাভাবনাগুলো করার জন্য আমাদের মধ্যে দুর্ভাগ্যকে সহন করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন- অসহনীয়তা আমাদের উত্তেজিত করে তোলে, যার ফলে আমরা দ্রুত এক সমাধান থেকে অন্য সমাধান চিন্তা করতে থাকি।
দুর্ভাগ্যবশত আধুনিক চিন্তাধারা আমাদের দুঃখ-কষ্ট সহন করার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সর্বাধুনিক চিন্তাধারা নিজের প্রচেষ্টা আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আমরাই আমাদের ভাগ্যের-নিয়ন্তা এরকম ভাবকে পুষ্টি প্রদান করে। আমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং প্রয়াসের মাধ্যমে যা কিছু অবাঞ্ছিত, তা দূর করে আমাদের বাঞ্ছিত বস্তু লাভ করতে পারি- এটিই আমাদের বিশ্বাস করতে শেখানো হয়। আমরাই আমাদের জীবন নিয়ন্তা, এই মতবাদটি আমাদের ইচ্ছানুসারে বদলানোর ক্ষমতা অনুসারে আমরা আমাদের সাফল্য এবং মূল্য নির্ধারণ করি। এরকম মতামত পোষণ করার ফলে অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি আমাদের শুধু হতাশই করে না, উপরন্তু ধ্বংস করে দেয়। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, আধুনিকতার প্রসারের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলোও বর্ধিত হচ্ছে।
যদি আমরা আবেগপ্রবণ না হয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অসুবিধাগুলোর সম্মুখীন হতে চাই, তবে সর্বনিয়ন্তার প্রতি আমাদের দুর্বল বিশ্বাসের মোকাবিলা করতে হবে। গীতার জ্ঞান এই ব্রহ্মা-ের বিভিন্ন স্তরের ভিত্তিতে আমাদের স্থান এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে উন্নত উপলব্ধি প্রদান করে। ভগবদ্গীতায় বলা (১৫.৭) হয়েছে, আমরা হচ্ছি আত্মা, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ। তিনি হচ্ছেন সর্বনিয়ন্তা এবং তাঁর অংশ হিসেবে আমরা আংশিক নিয়ন্তা। তাঁর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমত অসীম, কিন্তু আমাদেরটি সীমাবদ্ধ। আমাদের এই সীমাবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তাঁর সেবার কাজে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয়েছে, তা যেরকম পরিস্থিতিতেই আমাদের জীবন প্রবাহিত হোক না কেন। দুর্ভাগ্যের পরিস্থিতিতে তাঁর প্রতি যে সেবা সর্বোত্তম উপায়ে আমরা করতে পারি, তা হচ্ছে সহিষ্ণুতা।
কষ্টকে সহন করার অর্থ এই নয় যে, আমরা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছি, বরং এর অর্থ এই যে, আমাদের প্রথমে আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্য কর্ম করা উচিত, জড়জাগতিক সংশোধনের জন্য নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (১৮.৫৮) আমাদের উপদেশ দেয় ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন বরতে, যা আমাদের জড়জাগতিক বাস্তবতার চেতনা স্তরকে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করে, যেখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবার মাধ্যমে মুক্তি দেখতে পাই।
শ্রীমদ্ভাগবতে এমন বহু ভক্তের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, যারা তাদের প্রতিকূলতাকে আধ্যাত্মিকতা এবং ভক্তিমূলক সেবাকার্যের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন, যেটি তাদের সহনশীলতাকে পরিস্ফূট করে চিন্ময়ত্বে উত্তীর্ণ করেছে। এর প্রধান উদাহরণ শুরু হচ্ছে মহান রাজা পরীক্ষিতের মাধ্যমে, যিনি সামান্যতম অপরাধের কারণে অন্যায়ভাবে চরম অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এই অভিশাপের বিরুদ্ েপ্রতিশোধ না নিয়ে বা এর জন্য ক্রুদ্ধ বা বিরক্ত না হয়ে তিনি নিজেকে কৃষ্ণকথা শ্রবণে নিমগ্ন করেছিলেন, যার ফলে তিনি দেহাত্মবোধ থেকে চিন্ময়ত্বে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর নশ্বর দেহ নির্ধারিত গতি প্রাপ্ত হওয়ার আগেই তাঁর আত্মা মুক্তি প্রাপ্ত হয়েছিল, যা ঈর্ষান্বিত জড়জাগতিক প্রয়াসকারীদের দ্বারা করা সম্ভব নয়।
যদি আমরাও কোনো ভক্তিমূলক সেবাকার্যে নিয়োজিত হই, সেক্ষেত্রে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (১০.১০) নিশ্চিতভাবে এই আশ্বাস দেয় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অন্তর থেকে আমাদের নির্দেশ দেবেন, যাতে আমরা সেই পথ বুদ্মিত্তার সাথে নির্বাচন করতে পারি, যাতে আমরা তাঁর নিকটে ফিরে যেতে পারি।
যখন আমরা প্রতিক’লতার সম্মুখীন হই, তখন যদি আমরা আমাদের চেতনাকে আধ্যাত্মিক স্তরে প্রথমেই উন্নীত করতে পারি, তবে আমরা সেই বুদ্ধিমত্তা প্রাপ্ত হব, যাতে আমরা জড়জাগতিক স্তরে সেবামূলক মনোভাব নিয়ে সঠিক কাজ করতে পারি। ভাবে প্রতিকূলতাকে সহন করার শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা তাদের অতিক্রম করব এবং তাদের মাধ্যমে কৃষ্ণের সমীপেও অগ্রসর হব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন