রথযাত্রা -একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মহোৎসব

শ্রীজগন্নাথ প্রণাম
নীলাচল নিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে।
বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায়তে নমঃ ॥
আমি শ্রীবলদেব ও শ্রীমতি সুভদ্রাদেবীর সঙ্গে বিরাজিত শ্রীজগন্নাথদেবকে আমার প্রণতি নিবেদন করি। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র শ্রীনীলাচল ধামে নিবাস করেন। তিনি নিত্য এবং সর্বভূতান্তর্যামী পরমাত্মা।

ratha-yatra
রথযাত্রা  মহোৎসব
গৌড়ীয় বৈষ্ণব জগতে রথযাত্রা মহোৎসবটি অনন্য তাৎপর্য বহন করে। প্রতি বছর মহা আড়ম্বরের সাথে এই উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে। ভক্তগণ যেভাবে অধীর আগ্রহে এই উৎসবটির জন্য আকুল থাকে, অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সেই রথযাত্রা মহোৎসবটির উৎসভূমি ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত পুরী। শ্রীক্ষেত্র নামে পরিচিত পুরী ধামে সুপ্রসিদ্ধ শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে সুপ্রাচীনকাল থেকেই নিরবিচ্ছিন্নভাবে রথযাত্রা মহোৎসব পালিত হয়ে আসছে। কালক্রমে এই মহোৎসবটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন) প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের মাধ্যমে তা সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে। এখন পৃথিবীর অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে এই উৎসবটি পালিত হয়।
রথযাত্রা উৎসবের সামগ্রিক ভাবানুরাগটি হলো শ্রীকৃষ্ণকে কুরুক্ষেত্র থেকে শ্রীবৃন্দাবনে ফিরিয়ে আনা। পুরীধামে শ্রীজগন্নাথদেবের মহিমাম-িত সুবিশাল মন্দিরটি যেন দ্বারকাধামের রাজ্যের প্রতীকরূপে অধিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়- সেখানেই শ্রীকৃষ্ণ পরম ঐশ^র্য উপভোগ করে থাকেন এবং গু-িচার যে মন্দিরটিতে পরমেশ^রকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি তাঁর শ্রেষ্ঠ মাধুর্যময় লীলাবিলাসের ক্ষেত্র শ্রীবৃন্দাবনধামে রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। শ্রীজগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণেরই রূপ-শ্রীকৃষ্ণ যতই গভীরভাবে এবং একান্তভাবে ব্রজবাসীদের, গোপিকাদের এবং রাধারানীর কথা ভেবেছেন, ততই তাঁর সেই রূপ প্রকটিত হয়ে ওঠে।
বাহ্যিকভাবে রথযাত্রা চমকপ্রদ- বর্ণাঢ্য এবং মনোহারি। তবুও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী গৌড়ীয় বৈষ্ণবজন রথযাত্রা উৎসবটিকে শুধু একটি আনন্দোৎসব ছাড়া আরও বেশি কিছু মনে করেন। ভগবদ্ভক্তদের দ্বারা রথটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যেন ব্রজবাসীদের দ্বারা, বিশেষ করে রাধারানী আর গোপিকাম-লীর দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম এবং শ্রীমতি সুভদ্রাদেবীকে বৃন্দাবনধামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাৎপর্যই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। শ্রীবৃন্দাবনধামকে কৃষ্ণভক্তের অন্তর বলে মনে করা যেতে পারে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, “অধিকাংশ লোকের পক্ষেই মন আর হৃদয় একই হয়, কিন্তু যেহেতু আমরা মন কখনই বৃন্দাবন বিচ্ছিন্ন হয় না, তাই আমি মনে করি, আমার মন আর বৃন্দাবন এক হয়ে আছে, আর যেহেতু আপনি বৃন্দাবন ভালোবাসেন, তাই কৃপা করে আপনার চরণকমল সেখানে রাখবেন কি? তাতেই আমি আপনার পূর্ণ কৃপালাভ করব।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণকারীদের কাছে রথের দড়ি আকর্ষণের তাৎপর্য এই যে, তাঁরা ঐভাবে তাঁদের আরাধ্য শ্রীজগন্নাথদেবের তথা শ্রীকৃষ্ণের তন্ময় ভাবনামৃত তাঁদের হৃদয়ের মাঝে আকর্ষণ করে নিয়ে যান। পাশ্চাত্যে রথযাত্রার প্রবর্তক, শুদ্ধ ভগবদ্ভক্ত শ্রীল প্রভুপাদের অভিলাষক্রমে, পরমেশ^র ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর অনন্তবিস্তারী করুণা বিতরণের মাধ্যমে, আজ জগতের নাথরূপে সারা জগতের প্রধান মহলগুলোতে শোভাযাত্রা করে চলেছেন। সর্বত্রই মানুষ এই মহানন্দ ও বৈচিত্র্যময় রথযাত্রা উৎসবের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেছে। হাজারে হাজারে আনন্দকামী লোক এসে জড়ো হয়ে যায় বিরাটকার রথগুলি দেখবে বলে, খানিকটা কীর্তন করবে বলে, সকলের জন্য অকাতরে বিনামূল্যে বিতরিত সুস্বাদু প্রসাদ পাবার আকর্ষণে, কিংবা ভজন কীর্তন, নৃত্যানুষ্ঠান, প্রদর্শনী আর নানাবিধ- পারমার্থিক আনন্দানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আকুলতা নিয়ে। আর শ্রীজগন্নাথদেব যেহেতু ভগবানের পরম করুণাময় রথযাত্রার দর্শনতত্ত্ব কিছুমাত্র না বোঝা, তারাও শুধু এর মাঝে খানিকক্ষণ অংশ নিয়ে বা কিছুক্ষণ মাত্র দর্শন তৃপ্তি লাভ করেও সেই কৃপা সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন ঘরে ঘরে।
শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেবের এই রথযাত্রা মহোৎসব প্রতিবছর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) এর প্রতিটি কেন্দ্র ও শাখা কর্তৃক সারাদেশে একযোগে পালিত হয়। তাছাড়াও রথযাত্রা চলাকালীন ৯দিন ব্যাপী বর্ণাঢ্য উৎসব এবং মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয় প্রতিটি কেন্দ্রে। বিভাগীয় শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি স্থানে সাড়ম্বরে পালিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তগণ অত্যন্ত উৎসাহের সাথে মহাসমরোহে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন