ভগবৎসেবায় দৃঢ়তা কেন প্রয়োজন?

যে পন্থাটি এই কলিযুগে পতিত জীবাত্মাদের উদ্ধারের জন্য প্রদর্শিত ও নির্দেশিত হয়েছে, সেটি ব্যতীত আর অন্য উপযুক্ত কোনো পন্থা অবলম্বন করার ক্ষেত্রে আমরা যোগ্য নই। এটি অত্যন্ত সরল, যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক, অবধারিত, যা ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই। 




আমরা তপস্যা করবার যোগ্য নই। এমনকি এ কলিযুগে অষ্টকালীয় লীলা-স্মরণ করবারও যোগ্য নই। বাস্তবে এটি আমাদের ধারণারও বাইরে। দম্ভবশত আমরা জল্পনা-কল্পনা করতে পারি, কিন্তু শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর ‘রাগবর্ত্ম-চন্দ্রিকা’য় বলেছেন,
 এমনকি রাগানুগা-সাধনভক্তির অন্যতম অঙ্গ ‘স্মরণ’ শ্রীকৃষ্ণ-নাম-সঙ্কীর্তন (সংকীর্তন মানে হলো সমবেতভাবে কীর্তন) ব্যতিরেকে অসম্ভব।
কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম-সঙ্কীর্তনের সাথে সমন্বয় সাধন ছাড়া ভক্তিযোগের কোনো অঙ্গই সাধন করা সম্ভব নয়। এজন্যই আচার্যগণ বারবার হরিনাম সংকীর্তন করার ওপর জোর দিয়েছেন।

দৈন্যতা মানে হলো এটি উপলব্ধি করা যে, এই কলিযুগে আমরা কোনো কিছুর যোগ্য নই। আমরা কর্মযোগের যোগ্য নই, জ্ঞান, অষ্টাঙ্গযোগ, ধ্যান করার যোগ্য নই। আমরা প্রচুর পরিমাণ ঘি দিয়ে বড় বড় যজ্ঞ করার, ঐশ্বর্যপূর্ণ শ্রীবিগ্রহ অর্চন করার যোগ্য নই। 
শ্রীবিগ্রহ অর্চনের প্রয়োজনীয় স্বর্ণ, হীরক, মণিমুক্তা, ঐশ্বর্যপূর্ণ উপাচার কোথায়?                                                                       
কেন এসব প্লাস্টিক বা কৃত্রিম অলঙ্কার নিবেদিত     হচ্ছে?       

বড় বড় ডিগ্রি কোনো যোগ্যতা নয়। আমি, আপনি, আমরা কেউই যোগ্য নই। কেবল হরিনাম সঙ্কীর্তন যজ্ঞ ছাড়া আর কোনো কিছুর যোগ্য আমরা নই। এই বিনম্রতা বিস্তৃত হবে যখন আমরা আমাদের এই দুর্লভ মনুষ্যজীবনের দুর্লভ সময় এবং শক্তি হরিনাম সঙ্কীর্তন যজ্ঞে নিযুক্ত করব। 
একইসাথে অন্য সহায়ক সেবাসমূহ দৃঢ়তার সাথে সম্পাদন করতে হবে, যা আমাদের যুগধর্ম নাম সঙ্কীর্তনে আসক্তি বৃদ্ধি করবে। সেজন্য আমরা বিগ্রহ আরাধনায়, শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণে, প্রসাদসেবনে, মন্দির মার্জনে নিযুক্ত হই। কারণ এগুলো আমাদের হরিনাম করতে সহায়তা করে। 
এগুলো আমাদের সহায়তার জন্যই প্রণীত। কিন্তু আমরা যদি এই সেবাসমূহের উদ্দেশ্য না জানি, তবে তা ‘নিয়মাগ্রহ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি আমরা না জানি, 
  • শ্রীবিগ্রহারাধনার মূল উদ্দেশ্য হলো হরিনাম সঙ্কীর্তনে আমাদের আসক্তি বৃদ্ধি করা,                                                                           
  • শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের মুখ্য উদ্দেশ্য হরিনাম জপে আমাদের আসক্তি বৃদ্ধি করা,                                       
  • মন্দির মার্জনের মাধ্যমে সুন্দর পরিচ্ছন্ন মন্দিরে বাস ও সেবা করার একমাত্র উদ্দেশ্য সমবেতভাবে আমাদের হরিনাম সঙ্কীর্তনের সুযোগ বৃদ্ধি করা,                                                          
  • মন্দির পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য হলো হরিনাম সঙ্কীর্তন করার সুযোগ সৃষ্টি করা,                                                                             
  • সাধুসঙ্গের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরস্পরকে শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নামের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে কলিযুগের যুগধর্ম হরিনাম সঙ্কীর্তন ছাড়া আর কোনো পন্থা নেই।                                           
এটিই ভক্তিমূলক সেবার সর্বপ্রধান অঙ্গ এবং সনাতন ধর্মের মূল লক্ষ্যবস্তু। 
দৈন্যতা আমাদের আরো বুঝতে সহায়তা করে, যতক্ষণ না আমরা হরিনাম সঙ্কীর্তন শুরু করছি, আমরা হরিনাম সঙ্কীর্তনের রস আস্বাদন করতে পারবো না। আর কোনো উপায় নেই। আর কোনো পন্থা নেই। আর কোনো মার্গ নেই। কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা। একমাত্র উপায় হলো,
 ‘হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্’।
আমাদের কৃষ্ণপ্রেমের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হলে আমাদের এটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। এজন্যই বলা হয়েছে তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা। সহিষ্ণু হতে হবে বৃক্ষের মতো। যদি অগণিত মানুষও আমাদের সমালোচনা করে তবুও সবরকম বিপর্যয় সহন করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণের নাম সঙ্কীর্তনের মাধ্যমে আমাদের সকল সমস্যা দূরীভূত হবে। এটি খুব সহজ। যারা সহজভাবে এটি গ্রহণ করতে পারে, তাদের জন্যই এটি খুব সহজ। শ্রীল প্রভুপাদ এটিই আমাদের প্রদান করতে এসেছিলেন। 
অন্য সকল কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, যদি আমরা হরিনাম সঙ্কীর্তন না করি। যখন আমরা হরিনামের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি করি, তখনই অন্য সবকিছু সফল হবে।
 ‘অমানিনা মানদেন’, মানদেন মানে হলো প্রত্যেককে তাদের প্রকৃত স্বার্থ অনুসারে সম্মান প্রদান করা। প্রতিটি জীবের একমাত্র স্বার্থ হলো কৃষ্ণপ্রেম প্রাপ্ত হওয়া। আর সমবেতভাবে হরিনাম ছাড়া এর আর কোনো উপায় নেই। সেটিই পরিশেষে বলা হয়েছে, ‘কীর্তনীয় সদা হরি’ অর্থাৎ সর্বদা হরিনাম কীর্তনে যুক্ত হওয়া। 
যেমনটি আমি বলেছি, আমাদের হৃদয়ে নানা অনর্থ বিদ্যমান বলে আমরা সকলেই অসুস্থ। শ্রীহরিনামের প্রতি অপরাধ হলো, শ্রীহরিনাম জপের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস না থাকা এবং এত সব ব্যাখ্যা জানা সত্ত্বেও জাগতিক আকর্ষণ বজায় রাখা, যা হরিনামের চরণে দশবিধ নাম অপরাধের অন্যতম, আমাদের সকল সমস্যার মূল। আমাদের সাধুসঙ্গের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগাই না। 
সাধুসঙ্গ মানে কী? প্রধানত সাধুসঙ্গ বলতে বোঝায় সাধুর নিকট শ্রবণ করা, জিজ্ঞেস করা। কিন্তু আমরা তা করা সত্ত্বেও হরিনাম সঙ্কীর্তনে পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক, নাম যজ্ঞ আচরণে প্রতিবন্ধক জাগতিক আকর্ষণ বজায় রাখি। যারা সাধুর নিকট শ্রবণ করার পর তা মানসিকভাবে তা বিশ্লেষণ করে, তারাই বুঝতে পারে, সমবেতভাবে হরিনাম কীর্তন-ই আমাদের জাগতিক ও পারমার্থিক সকল সমস্যা দূর করতে সক্ষম। জাগতিক মঙ্গল পারমার্থিক মঙ্গলকে অনুসরণ করে। তাই পারমার্থিক সমস্যা দূর হলেই জাগতিক সমস্যা দূরীভূত হবে। কিন্তু যদি আমরা আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস না থাকার দরুণ পূর্ণরূপে এতে নিমজ্জিত না হই, তা ফলপ্রসূ হবে না। যেহেতু আমরা সকলেই অসুস্থ, তাই আমাদের কিছু বিধি-নিষেধ অনুসরণ আবশ্যক আমাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করবার জন্য। 
দাহরণস্বরূপ, জন্ডিস হলে মিছরি তেতো মনে হয়। তেমনি হরিনামে আমরা স্বাদ পাইনা। এটি সারাবার উপায় এমন নয় যে, মাসে একবার একটি অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট খেলাম, আর রোগ সেরে গেল। আমাদের বৈধী ভক্তির পন্থা অনুসরণ করতে হবে। 
ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠতে হবে, যখন নাম ভজনে সহস্রগুণ অধিক কৃপা লাভ হয়। মঙ্গলারতিতে যুক্ত হতে হবে, শ্রীবিগ্রহগণকে দৃঢ়ভাবে দর্শন করতে হবে। মূলত, আমরা শ্রীবিগ্রহগণের সম্মুখে এজন্য উপস্থিত হই, যাতে শ্রীবিগ্রহগণ আমাদের প্রীতভাবে হরিনাম সংকীর্তনে নৃত্য-কীর্তন করতে দেখেন। এভাবে গুরু-কৃষ্ণের সন্তুষ্টির দ্বারা আমাদের অনর্থ নিবৃত্তি হবে।

শ্রীপাদ ঐন্দ্র প্রভু ইসকনের ভুবনে কীতনসম্রাট নামে সুবিদিত। তিনি তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের নির্দেশে শ্রীবৃন্দাবন ধামে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী হরিনাম সংকীর্তনে নিযুক্ত হন। তাঁর নিকট উৎসাহ পেয়ে অনেক ভক্ত হরিনাম সংকীর্তনে যুক্ত হন। ফলে প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে ইসকন বৃন্দাবনের শ্রীশ্রীকৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরে সারাদিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন অব্যাহত রয়েছে। কলিযুগের যুগধর্ম হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনের তিনি এক মহান প্রচারক। ইসকনের প্রায় সকল কীর্তনীয়াই তাঁর নিকট অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। তাঁর ন্যায় বিনয়ী এবং শুদ্ধবৈষ্ণব খুব দুর্লভ
২০১০ সালের ১৫ মে, প্রাত্যাহিক শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচনের সময় পাঠকের অনুপস্থিতির কারণে মন্দির কর্ত ৃপক্ষের অনুরোধে তিনি শ্রীমদ্ভাগবত কথা আলোচনা করেন এবং কেন আমরা তদনন্দিন সেবা করছি তা তুলে ধরেন। এটিই ছিল শ্রীপাদ ঐন্দ্র প্রভুর সর্বশেষ শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচন। 

প্রবচনটির বঙ্গানুবাদ এখানে সংক্ষেপে প্রদত্ত হয়েছে। মূল প্রবচন শ্রবণ করুন এখানে

ভগবৎসেবায় দৃঢ়তা কেন প্রয়োজন? (মূল ভিডিও)

অনুবাদ : মাধুর্য দাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন