বেদরূপা সরস্বতী

সৃষ্টির প্রারম্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মাকে সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রের জ্ঞান প্রদান করেন। এই সমস্ত জ্ঞান ব্রহ্মার থেকে পরম্পরাসূত্রে ঋষিগণের মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বেদের জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করার জন্য ঋষিগণ বেদমাতা সরস্বতীর আরাধনা করেছেন, পূর্বগামিনী নদীরূপিনী সরস্বতীর তীরে বৈদিক জ্ঞানের চর্চা করেছেন। সরস্বতী দেবীর কৃপাতেই বেদের পরা-জ্ঞান লাভ হয়, তা শ্রীব্যাসদেব নিজে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণতি জ্ঞাপন করে প্রকাশ করেছেন। 



সাধারণত, মানুষের একটি ভুল ধারণা হলো কৃষ্ণভক্তগণ দেব-দেবীদের আরাধনা করেন না। কৃষ্ণভক্তগণ নানারকম কামনা-বাসনার ফলে হৃতজ্ঞান হয়ে দেব-দেবীর আরাধনা করেন না সত্য, তবে তাঁরা দেব-দেবীগণের প্রকৃত পরা-স্বরূপের আরাধনা করেন, যা জীবের পঞ্চম-পুরুষার্থ কৃষ্ণপ্রেম লাভের সহায়ক হয়। যে সমস্ত জ্ঞান জড় ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যেই আবর্তন করে, তা হলো অপরা জ্ঞান। কিন্তু যে জ্ঞান মানুষকে দুঃখালয়-অশাশ^ত অনিত্য জড়জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে, সেটিই হলো পরা-জ্ঞান। তা জড়জগতের সংসর্গ থেকে মুক্ত। এই জ্ঞানলাভের জন্যই কৃষ্ণভক্তগণ প্রতিদিন শ্রীসরস্বতীকে স্মরণ করে থাকেন-

দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয়মুদিরয়েৎ । 

শ্রীমদ্ভাগবত ১।২।৪    

যে অপ্রাকৃত চিন্ময় জ্ঞান লাভের মাধ্যমে জীব জড়জগতের দুঃখকে জয় করতে পারে, সেই অপ্রাকৃত জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করার জন্য সরস্বতী দেবীকে বৈষ্ণবগণ নিত্য প্রণাম করে থাকেন। কিন্তু এই পরা-বিদ্যারূপিণী সরস্বতী কীভাবে পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হন, তা স্বয়ং সরস্বতী দেবীই তৎকালীন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে জানিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে কেবল ব্যাকরণশাস্ত্রে পণ্ডিত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন সরস্বতীর বরপ্রাপ্ত সর্ববিদ্যাবিশারদ কেশব কাশ্মিরীকে বিদ্যাতর্কে পরাস্ত করলেন, তখন মনোদুঃখে তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন। স্বপ্নে সরস্বতী দেবী তাকে জানান,

যত কিছু মন্ত্র তুমি জপিলে আমার।

দিগি্বজয়ী-পদ-ফল না হয় তাহার  ।।

মন্ত্রে যে ফল, তাহা এবে সে পাইলা।

অনন্ত-ব্রহ্মাণ্ডনাথ সাক্ষাতে দেখিলা ।।

যাহ শীঘ্র, বিপ্র, তুমি ইহান চরণে।

দেহ গিয়া সমর্পণ করহ উহানে  ।।

“তুমি যে সারাজীবন মন্ত্র জপ করেছ,  দিগ্বিজয়ী পদ তার উপযুক্ত ফল নয়। তার প্রকৃত ফল তুমি এখন পেয়েছ, পরমব্রহ্ম অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডনাথ ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে তুমি সাক্ষাৎ দর্শন করেছ, এখন তুমি তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করো।” 

শ্রীচৈতন্যভাগবত, আদি ১৩।১৪৫-১৪৭

শুধু এটিই নয়, সরস্বতী দেবী যে কৃষ্ণভক্তির চর্চাতেই অধিক তুষ্ট হন, তার আরো প্রমাণ দৃষ্ট হয়।

ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সারদা পীঠ। যদিও দ্বাদশ শতকে এর প্রভাব হ্রাস পায়, তবে দেবী সরস্বতীর কৃপাপুষ্ট স্থানটি দীর্ঘকাল বিদ্বান ব্যক্তিবর্গের সমাগম স্থান ছিল। পুরাণে সারদা-মাহাত্ম্যে সত্যযুগে যজ্ঞকুণ্ড থেকে ‘বাক্’ দেবী সরস্বতীর সারদা নামে অবতরণ এবং এখানে নিত্য অবস্থানের বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাসে খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে কুষাণ সাম্রাজ্যেরে সময় থেকেই এখানে বিদ্যাচর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য এখানে বিশাল ভবনাদি তৈরি করেন। শ্রীসম্প্রদায়ের প্রধান আচার্য শ্রীরামানুজাচার্য তাঁর গুরুদেব শ্রীযামুনাচার্যের আজ্ঞায় ‘বোধায়নবৃত্তি’ গ্রন্থের আলোকে ব্রহ্মসূত্রের শ্রীভাষ্য রচনা করেন। বেদান্তের যথার্থ ও অকৃত্রিম ভাষ্য শ্রীমদ্ভাগবতের পরেই বৌধায়ন ঋষি রচিত ভাষ্য ব্রহ্মসূত্রের দ্বিতীয় ভাষ্য। শ্রীভাষ্য রচনার জন্যে শ্রীরামানুজ সারদাপীঠে গুপ্তভাবে সংরক্ষিত মহর্ষি বৌধায়ন রচিত একমাত্র বোধায়নবৃত্তির পাণ্ডলিপি দর্শনে গমন করেন। কিন্তু বোধায়নবৃত্তিতে ব্রহ্মসূত্রের কৃষ্ণভক্তিময় ভাষ্যই বিরচিত আছে। তা প্রচারিত হলে মায়াবাদ বিলুপ্ত হবে বলে সারদাপীঠের মায়াবাদী পণ্ডিতগণ বোধায়নবৃত্তি গ্রন্থ কীটের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে বলে অসত্য জানান। শ্রীরামানুজ তা বিশ্বাস করে দুঃখিত মনে সারদাপীঠের নিকটেই অবস্থান করছিলেন। তখন রাত্রিতে হঠাৎ স্বয়ং সরস্বতীদেবী আবির্ভূত হয়ে মূল পাণ্ডলিপি তাঁকে প্রদান করেন। তাঁর কৃপাতেই শ্রীরামানুজ বোধায়নবৃত্তি সংগ্রহ করে শ্রীমদ্ভাগবত অবলম্বনে জগতে বিষ্ণুভক্তির সিদ্ধান্ত প্রকাশক শ্রীভাষ্য রচনা করতে সমর্থ হন। এই ঘটনাটিও সরস্বতীদেবীর অন্যসব কিছু থেকে কৃষ্ণভক্তির প্রতি অধিক প্রীতি প্রকাশ করে।  

শ্রীমদ্ভাগবত আমাদের পরমেশ্ব ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্মল ভক্তি শিক্ষা দেয়। পরমেশ^র ভগবান সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মাকে শ্রীমদ্ভাগবতের অপ্রাকৃত জ্ঞান প্রদান করলে সেই জ্ঞানই সরস্বতীরূপে আবিভর্‚ত হন। শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৪।২২ বলা হয়েছে, “কল্পের প্রারম্ভে ব্রহ্মার হৃদয়ে সৃষ্টিবিষয়ক জ্ঞান প্রকাশ করে ব্রহ্মার মুখ থেকে বাণীরূপে বেদরূপা সরস্বতী যাঁর দ্বারা প্রেরিত হয়েছিলেন এবং সেই সরস্বতী যাঁকে আরাধনা করেন, সেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানদাতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।”

এমনকি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণেও দেবী সরস্বতী স্পষ্টভাবে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনের নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে উত্তর খণ্ডে (৬।৩৮) বৃষভানু মহারাজের প্রতি বাগ্দেবী সরস্বতীদেবীর উক্তি,

হরিনাম বিনা বৎস কর্ণশুদ্ধির্ন জায়তে।

তস্মাৎ শ্রেয়স্করং রাজন্ হরিনামানুকীর্তনম্  ।।

“হে পুত্র, হরিনাম গ্রহণ না করলে কর্ণ শুদ্ধ হয় না। হে রাজা, এজন্যই তুমি অতি শ্রেয়স্কর হরিনাম নিত্য কীর্তন করো।”

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও শিক্ষাষ্টকে হরিনাম-সংকীর্তনকেই বিদ্যাবধূ সরস্বতীর জীবন বলে বর্ণনা করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণের উক্ত অধ্যায়েই শ্রীহরির সর্বশ্রেষ্ঠ নামসংকীর্তনের উল্লেখ রয়েছে,

তদহং বোভিধাস্যামি মহাভাগবতোহসি।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ।।

 ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, উত্তর ৬।৫৪-৫৫

“হে মহাভাগবত রাজা, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে  ।। হচ্ছে সেই মন্ত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”

হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমেই দেবী সরস্বতীর কৃপা লাভ করে শ্রীরূপ-সনাতন-জীব গোস্বামী, বলদেব বিদ্যাভ‚ষণ প্রভৃতি মহান আচার্যগণ মহান পণ্ডিত রূপে বিখ্যাত হয়েছিলেন। অতএব, যদি আমরা প্রকৃতই সরস্বতী দেবীর কৃপা লাভ করতে চাই, তবে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র সংকীর্তনের মাধ্যমেই তাঁর আরাধনা করা উচিত। তাহলেই সেই বিদ্যারূপিনী সরস্বতী আমাদের ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি  নিত্য কৃপা বর্ষণ করবেন।

 মাধুর্য্য দাস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন